বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

রেশমের সুদিন ফিরে এসেছে



রেশমের সুদিন ফিরে এসেছে

খাসজমি রেশম চাষের আওতায় আনার দাবি


মোঃ সালাউদ্দিন )( ভোলাহাট [ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ] :: রেশমের সুদিন ফিরে আসলেও দেশের শতকরা ৭৫ ভাগ কাঁচা রেশম উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে রেশমের রাজধানী ও রেশমের প্রাচীন নগরী নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী ভোলাহাট উপজেলার রেশমচাষীরা রেশম চাষে আগ্রহী হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে রেশম চাষে ফিরে আসতে পারছে না।


৯০-এর দশকে সরকারের আত্মঘাতী ভ্রান্তনীতির কারণে তথা উদার বাজার অর্থনীতির ধাক্কায় এ অঞ্চলের রেশম চাষ মুখ থুবড়ে পড়ে । বিদেশী রেশম সূতা শুল্কমুক্তভাবে দেশের বাজারে প্রবেশ করায় পুরো রেশমের বাজার চলে যায় বিদেশী রেশম সুতার হাতে। আর দেশী রেশম সুতা গুণ, মান ও কম মূল্যের কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মূল বলয় হতে ছিটকে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। রেশম চাষীরা বাধ্য হয়ে  চৌদ্দ পুরুষের পেশা রেশম চাষ ছেড়ে অনাহার, অর্ধাহার ও ঋণগ্রস্ত হয়ে চলে যায় অন্য পেশায়। ফলে মূল্যবান তুঁত জমিগুলো পরিণত হয় আম বাগান ও সবজির জমিতে। সে সময় রেশম গুটির মূল্য সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে সর্ব নিম্ন দর মণপ্রতি মাত্র দেড় হাজার টাকায় নেমে আসে। ফলে দেশীয় রেশম শিল্পের ঘটে সর্বনাশ। আজ প্রায় ২০ বছর ব্যবধানে সেই ধ্বংস প্রাপ্ত রেশম শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিদেশী রেশম সূতায় পর্যাপ্ত করারোপ করায় দেশী রেশম সূতার যেমন মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সে সাথে কদরও। বর্তমানে প্রতি মণ রেশম গুটি ৯-১০ হাজার টাকা মণ দরে ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে। তা দেখে আদি রেশম চাষীরা আবারো আগ্রহী হয়ে উঠেছে রেশম চাষে। ঘর মুখো হয়ে আবারো ফিরতে চায় রেশম চাষে।
একেতো মূল্য বৃদ্ধি তার ওপর ইতোপূর্বে ১০০ ডিম বীজ পালন করে যেখানে ২৫-৩০ কেজি গুঁটি হতো, সেই স্থানে রিসার্চ এ্যাকশন প্ল্যান উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও  আধুনিক পলু পালনে প্রশিক্ষণ দিয়ে  বর্তমানে  ১০০ ডিম বীজে উৎপাদন করছে ৭৫ হতে ৮০ কেজি। এর মূল্য প্রায়  ১৫ হতে ২০ হাজার টাকা। সে হিসেবে বর্তমানে রেশম বোর্ডের তথ্যানুযায়ী এক বিঘে জমিতে ৩০০ ডিম বীজ পালন করে একটি মৌসুমে সহজেই ১৮০-২৪০ কেজি কাঁচা রেশম বা রেশম গুটি উৎপাদন করা সম্ভব। সে হিসেবে বছরে চারটি রেশম মৌসুমে এক বিঘে জমি হতে ৭২০ হতে ৯৬০ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন সম্ভব। এর মূল্য প্রচলিত বাজারে দাড়ায় ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। যা অন্য কোনো ফসলে এক  বিঘে জমি হতে বছরে এত টাকা আয় করা সম্ভব নয়।
এ দিক লক্ষ্য রেখে ভোলাহাটের সুনিপুন আদী ও অকৃত্রিম হাজারো রেশম চাষী আবারো রেশম চাষে আগ্রহী। কিন্তু তুঁত চাষ উপযোগী জমি পাওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু তুঁত জমিগুলো  আম বাগানে পরিণত হয়েছে, তা বিনিষ্ট করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে রেশম চাষীরা পড়েছে উভয় সংকটে। রেশম চাষীদের দাবী ১৯৪৭ এর পরবর্তী সময়ে মহানন্দা নদীর সর্বনাশা ভাঙ্গনে প্রায় ২৬২ একর মূল্যবান তুঁত জমি পর্যায়ক্রমে নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। ভেঙ্গেছে এপার আর গড়েছে ওপার। তাই ভারত সীমানা জুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। এটি বর্তমানে উঁচু জমিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ৬৫ বছর উক্ত চরের জমি ভারত পর্যায়ক্রমে কুক্ষীগত ও ভোগ দখল করে আসছিল। ২০০৮ সালে আপোসে উভয় দেশের জরীপ ও সীমান্ত রক্ষীদের মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণের পর ২০১১ সালে চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ ওই  চরের অধিকার ফিরে পেয়েছে। ভোলাহাটের আম জনতা, হাজারো আদি রেশম চাষী ও বোর্ড কর্তৃপক্ষ উক্ত নদী শিতস্তী চরের জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকৃত আদী প্রান্তিক রেশম চাষীদের খন্ডকালীন মেয়াদী লীজের মাধ্যমে প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসক এবং রেশম বোর্ড বরাবরে লিখিত আবেদন জানিয়েছে। রেশম চাষীদের অভিমত উক্ত বিষয় বাস্তবায়ন করলে আবারো রেশমের সুদিন ফেরে আসবে। অর্থনৈতিক সাবলম্বি, বেকারত্ব লাঘব ও অধিকতর বেকার নারীর কর্মসংস্থান হবে। রেশম শিল্পে স্বনির্ভর হবে দেশ।               রেশম বহু উৎপাদন মুখী একটি কৃষি ভিত্তিক শিল্প। এর একদিক (ডিম হতে গুটি উৎপাদন পর্যন্ত) কৃষি ভিত্তিক এবং গুটি হতে বস্ত্র উৎপাদন পর্যন্ত শিল্প ভিত্তিক। রেশম শিল্পে ফেলানা বা ওয়েস্টেজ বলতে কিছু নেই। এর রেশম তুঁত পাতার উচ্ছিষ্টাংশ ডাটা হতে আসে জ্বালানী ও গো খাদ্য, রেশম গুটি হতে আসে ওয়েস্টেজ । ওয়েস্টেজ হতে আসে  লাট, ঝুট, গেঁটে। এ ওয়েস্টেজও ফেলানা নয়। ওই  ওয়েস্টেজ হতে আসে মটকা স্পান সিল্ক বা খাদী, যা মহিলারা টাকু ও চরকার সাহায্যে আরেক ধরণের সুতা উৎপাদন করে থাকে। রেশম কীটের মলমূত্র থেকে আসে উন্নতমানের জৈব সার। রেশম গুটির মথ হতে আসে উৎকৃষ্ট মানের গবাদী পশু ও হাঁসমুরগীর খাবার।
তাই রেশম শিল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আর্শিবাদ। এ শিল্পে বেকারত্ব থাকে না। পঙ্গু মানুষও রেশম চাষের সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই রেশম চাষ পুঁজি বিহীন আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তুলতে সহায়ক এবং আত্মমর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বি হবার বিশেষতঃ মহিলাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অন্যতম প্রধান উপাদান। দেশ ও বিদেশে রেশম চাহিদা প্রচুর। বর্তমানে দেশে প্রতিবছর রেশমের চাহিদা ৩০০ মেঃ টন।  বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ৫০ মেঃ টন। বাকী রেশম সুতা আমদানী করতে হচ্ছে বিদেশ হতে। দেশে ব্যাপক হারে রেশম চাষের ক্ষেত্র সৃষ্টি হলে দেশের চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর পরিমাণ রেশম বস্ত্র বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা অতুজ্জ্বল বলে মতামত দিয়েছেন সিল্ক ম্যানুফ্যাকচার এন্ড এক্সপোট এ্যাশোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেমাব) এর সভাপতি মোঃ আলাউদ্দিন। তিনি ভোলাহাটের রেশম চাষীদের সাথে এ বিষয়ে একমত এবং তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের পর মহানন্দা নদীর গর্ভে বহু মূল্যবান তুঁত জমি বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে ওই  সমস্ত জমি জেগে উঠেছে মহানন্দার অপর পাড়ে ভারত সীমানা ঘেঁষে। দীর্ঘ ৬৫ বছর ভারত ওই  সমস্ত চরের জমি একতরফাভাবে ভোগ দখল করে আসছিল। বর্তমানে উক্ত জমি ২০১১ সালে ভারতের নিকট থেকে বাংলাদেশ বুঝে পেয়েছে। ২৬২ একর এলাকা বিশিষ্ট সুবিশাল ওই  চরে রেশম চাষ করলে ভোলাহাটে আবারো রেশমের সুদিন ফিরে আসবে। মুছে যাবে বেকারত্বের গ্লানি। ঘুচ যাবে অর্থনৈতিক দৈন্যতা। স্বাবলম্বি হবে এলাকাবাসী। দেশ হবে রেশম শিল্পে আত্মনির্ভরশীল। শুধু তাই নয় বিদেশেও রেশম বস্ত্র রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ আয় করা সম্ভব। তিনি মহানন্দা চরের রেশম চাষ উপযোগী ওই  জমিগুলো  প্রকৃত ও আদী রেশম চাষীদের মেয়াদী ও খন্ড মেয়াদের লীজ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক  বরাবরে আবেদন করেছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে রেশম বোর্ড চেয়ারম্যান সুনীল চন্দ্র পালও একমত এবং রেশম চাষ সম্প্রসারণের জন্য তিনি জেলা প্রশাসক বরাবরে রেশম চাষীদের লিখিত আবেদনটি পাঠিয়েছেন বলে জানান।  রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটউট এর পরিচালক আব্দুল হামিদ মিয়া ও এ বিষয়ে একমত পোষন করেন।তিনি বলেন পার্বত্য পট্টগ্রাম এর বিস্তির্ন পতিত জমি অনাবাদী পড়ে আছে।সেসকল জমি রেশম চাষের আওতায় আনা গেলে এ দেশের  প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত রেশম বিদেশে রপ্তানী করার মত  সম্ভাবনা  ও সুযোগ  রয়েছে ।
 চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক কেএম আলী আজম বলেন, যেহেতু ভোলাহাট উপজেলা রেশম শিল্পের কেন্দ্রভূমি। সেহেতু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দলের মতামত  ও জরীপ রিপোর্ট প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন। 
তিনি বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিলে ভোলাহাট তথা দেশের রেশম শিল্পের বৃহৎ স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে জানান। এ বিষয়ে ভোলাহাট রেশম জোনের সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম জানান, স্থানটি রেশম চাষের উপযোগী। প্রকৃত প্রান্তিক রেশম চাষীদের মেয়াদী ভিত্তিতে লীজ দিলে রেশমের সুদিন ফিরে আসবে। স্বনির্ভরতা অর্জন করবে রেশম শিল্প। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ওই  স্থানে শাহ নিয়ামতউল্লাহ বহুমুখী রেশম কীট শিল্প সমবায় সমিতি লিঃ (রেজিঃ প্রাপ্ত) পরীক্ষা মূলকভাবে রেশম চাষ প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে। রেশম বোর্ডের খন্ডকালীন সদস্য ইয়াসিন আলী শাহ ও সেমাবের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহীর কমিটির ভোলাহাট প্রতিনিধি আব্দুর রহমান জিন্নাত একই কথা বলেন।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব


কাপ্তাই রেশম গবেষনা কেন্দ্র পুরোদরম চালু করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব






বার্তা লাইভ ২৪ ডটকম,মাহফুজ আলম, কাপ্তাই(২২ মার্চ): 

কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত চন্দ্রঘোনায় সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক রেশম গবেষনা কেন্দ্রটি পুরোদমে চালু করা গেলে, অল্প সময়ের ব্যাবধানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সহজ হতে পারে। পার্বত্য কাপ্তাইয়ের গরীব দুঃখী মানুষগুলো সল্প আয়ের বিনিময়ে শ্রম দিতে আগ্রহী। শ্রমিকদের যথাসময়ে অল্প খরচের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে রেশম গবেষনা কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু করার সুযোগ বয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পার্বত্য কাপ্তাইয়ের পাহাড়ী মাটি, জলবায়ু ও আর্থসামাজিক অবস্থা পুরোপুরি অনুকুলে থাকা অবস্থায় কাপ্তাই এলাকায় চন্দ্রঘোনা রেশম চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগহাতে পারলে চন্দ্রঘোনা আঞ্চলিক গবেষনা কেন্দ্র থেকে রেশম চাষের উজ্বল সম্ভাবনা কাজে লাগবে। বিশেষ করে পার্বত্য কাপ্তাই অঞ্চলের চন্দ্রঘোনায় তুঁত ও অতুঁত রেশম চাষের অনুকুল পরিবেশ রয়েছে। রেশম গবেষনা কেন্দ্রটি রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইয়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নিরীহ-গরীব ও বেকার। তাই রেশম গবেষনা কেন্দ্রটি চালু করে বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থার পাশাপাশি পুরোদমে চালু করা গেলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক অর্জন করার সুয়োগ সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় পাবে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধিপাবে তুঁত ও অতুঁত থেকে রেশম উৎপাদন। এই রেশম উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা পুরণ করে বিদেশেও রেশম রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনার সুযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা আঞ্চলিক গবেষনা কেন্দ্রটি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার সরাসরি নিয়ন্ত্রনাধীন ১৯৬২ সালে রেশম বীজাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর পর রেশম বীজাগারটি বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের আওতায় বীজ বর্ধন ও পুলুর মাতৃ পিতৃজাত (পিতৃ) রক্ষনাবেক্ষনের কাজে ব্যাবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে সরকারী এক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের নিয়ন্ত্রনাধীন কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা রেশম বীজাগারটিকে বাংলাদেশ রেশম গবেষনা ও প্রশিক্ষন ইন্সটিটিউটের (বিএসআরটিআই) অধিরে ন্যাস্ত করেচন্দ্রঘোনা আঞ্চলিক রেশম গবেষনাগারে রুপান্তরিত করে।