বিলুপ্তির পথে দেশীয় রেশম শিল্প
দেশবাসীর অগোচরেই নীরবে নিভৃতে দেশীয় রেশমি সুতোর দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কৌলিন্য, ঐতিহ্য-অহংকারের রেশম শিল্পের আজ বড় দুর্দিন। রেশমী সুতো এখন আসে চীন থেকে । আর সেই সুতোয়
বোনা কাপড় রাজধানীসহ গোটা দেশে পরিচিতি পাচ্ছে রাজশাহী সিল্ক নামে। রেশম শিল্পের সোনালি অতীত এখন শুধুই ইতিহাস। বর্তমানে রাজশাহী সিল্কের অস্তিত্ব রয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। অথচ অনেকেই জানেন না যে,এখন এই শিল্প আসলে রাজশাহীতে উৎপাদিত রেশম সুতোর উপর নির্ভরশীল নয়। রেশম শিল্পের মালিকরা বলছেন, দেশে রেশমী সুতোর উৎপাদন তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই এখন রাজশাহী সিল্কে ব্যবহৃত হয় চীন থেকে আমদানিকৃত রেশম সুতো।
প্রকাশ, বিদেশ থেকে সুতো কম আসায় সুতোর দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে। বিগত বছর যে সুতো এক হাজার ২শ’ টাকা থেকে এক হাজার ৩শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে, এবার তা বেড়ে আড়াই হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর ব্যবসায়ীদেরকে বেল হিসাবে কিনতে হয় এই সুতো । ৬০-৭০ কেজিতে হয় এক বেল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরম প্রতিকূলতার মাঝে পড়ে অনেক প্রিন্টিং ও উইভিং ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম সিল্কের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ঊষা সিল্ক প্রিন্টিং এন্ড উইভিং ফ্যাক্টরীর রেজাউল করিম রোকন ইত্তেফাককে জানান, দেশে এখন রেশমের পূর্ণাঙ্গ ফ্যাক্টরী আছে মোটে ৬টি। এছাড়া উইভিং আছে ২৫-২৬টি। প্রিন্টিং আছে ২৭টি। আগে ছিল শতাধিক। তিনি জানান, সিল্কের সুতো পুরোটাই প্রায় চীন থেকে আসে। দেশে কয়েকটি এনজিও এখন ভোলারহাট, নবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, পঞ্চগড় ও বাঘায় রেশম চাষ করছে। দেশীয় রেশম অতি উন্নতমানের। এটার আঁশ মোটা। দামও কম। তবে তা চাহিদার তুলনায় কিছুই না।
এই শিল্পের দুরবস্থার নেপথ্যে রেশম ভবনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রধানতম কারণ। সরেজমিনে দেখা যায়, চার বছর আগেও রেশম শিল্পের যে ভবনগুলো মুখরিত থাকতো মেশিনের একটানা আওয়াজ আর শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যে, ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর কারখানা বন্ধ হবার পর থেকে সেই ভবনগুলো এখন যেন মৃত্যুপুরি।
রাজশাহীর রেশম ব্যবসায়ীরা ইত্তেফাককে জানান, এখানকার কোন ব্যবসায়ীই এখন আর সুতো উৎপাদন করছেন না। এখন তাদের কার্যক্রম উইভিং, প্রিন্টিং আর মার্কেটিং পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। অথচ একসময় রাজশাহীতে ব্যবসায়ীরা সিল্ক সুতো উৎপাদন করতেন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতোর পাশাপাশি চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সামান্য পরিমাণে সুতো আমদানি করা হতো। তবে প্রসিদ্ধ রাজশাহী সিল্ক মূলত তৈরি হতো স্থানীয় সিল্ক সুতো থেকে।
স্থানীয় সিল্ক সুতোর বড় সরবরাহ আসতো প্রতিবেশী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট থেকে। সেখানে রেশম চাষিরা এটা ছেড়ে অন্য চাষাবাদে চলে গেছে। সেখানকার সিল্ক সুতো উৎপাদনের ইতিহাস প্রায় এক হাজার বছরের পুরানো। সেই সময় তৈরি সিল্ক কাপড়ের ৮০ শতাংশেই ব্যবহৃত হতো স্থানীয় সুতো। তখন যারা সুতো উৎপাদন করতেন, কেবল তারাই দেশের বাইরে থেকে সিল্ক সুতো আমদানির লাইসেন্স পেতেন। সেই দৃশ্যপট পাল্টে যায় ১৯৯১ সালের পর থেকে। সরকার নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয় সিল্ক সুতা আমদানির লাইসেন্সের ক্ষেত্রে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে সিল্ক সুতা উৎপাদন না করলেও যে কেউই তা আমদানি করতে পারবে। ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে ট্যাক্স তুলে নেয়া হয় আমদানিকারকদের ওপর থেকে। ফলে অতি উৎসাহী ব্যবসায়ীদের কারণে বাজার সয়লাব হতে শুরু করে চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর উজবেকিস্তান থেকে আমদানি করা নিম্নমানের সিল্ক সুতা দিয়ে। সরকারি সিদ্ধান্তের সুযোগে এসব সুতার আমদানি যতো বাড়তে থাকে স্থানীয় সিল্ক সুতার উৎপাদনও ততোটাই হোঁচট খেতে থাকে।
এক পর্যায়ে সরকার আবারও নেয় নতুন সিদ্ধান্ত। এবারের সিদ্ধান্তে আমদানিকৃত সুতার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারিত হয়। পরে সেই ভ্যাট বাড়িয়ে ২২ শতাংশ করলেও এতে স্থানীয় পর্যায়ে সিল্ক সুতা উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোনও ফায়দা হয়নি। উল্টো আরও বেশি বিপাকে পড়েছেন রেশম ব্যবসায়ীরা। এদিকে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর রাজশাহী রেশম কারখানা বন্ধ ঘোষণার পর রেশম শিল্পকে বাঁচাতে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের কোনও উদ্যোগই আর অবশিষ্ট নেই। ২০০১ সালেই ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই কারখানায় বিএমআরআই মেশিন কেনা হয়। এর মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেশিনগুলো পড়ে আছে অচল হয়ে।
বন্ধ হয়ে যাবার আগে রেশম কারখানার কাঁধে ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণের বোঝা। অথচ ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬১ সালে ৪৭১ জন শ্রমিক-কর্মচারি নিয়ে চলতে শুরু করা ঐতিহ্যবাহী এই কারখানা ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেছে। ১৯৭৮ সালে রেশম বোর্ডের হাতে কারখানা ছেড়ে দেয়ার পর শুরু হয় লোকসানের পালা। সিবিএ নেতা আতাউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ওই কারখানায় প্রায় ১২ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এই কারখানাটি বন্ধের পর আবারও চালু হবে হবে করলেও আজও তা চালু হয়নি।
রাজশাহী রেশম বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সওদাগর মাহফুজার রহমান জানান, রেশম কারখানাটিকে কিভাবে লাভজনক খাত হিসাবে চালু করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আড়াই বছর আগে দায়িত্বে থাকাকালেই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছিলো। এই ব্যাপারে বর্তমান চেয়ারম্যান জানান, সর্বশেষ গত বছরের ৯ জুলাই আহবায়ক কমিটির সভা হয়েছে। ঐ সভায় রাজশাহী রেশম কারখানাটি আবারও চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কারখানা চালু করার মত অর্থ রেশম বোর্ডের কাছে নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কিছু মূলধন পাওয়া গেলে কারখানা চালু করা যাবে। তবে বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ইত্তেফাককে বলেছেন, আমি চেষ্টা করছি এই কারখানাটি আবারও চালু করার জন্য । সরকার সহযোগিতা করলে এই উদ্যোগ সফল হবে।
জানা যায়, রাজশাহী রেশম কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই রাজশাহীতে প্রস্তাবিত রেশম নগরী গড়ে তুলবার পরিকল্পনাটি বিএনপি সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। সে সময় কারণ হিসাবে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ তুলে ধরা হয়েছিল। প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে রেশম নগরী গড়ে তোলা যুক্তিহীন বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন