বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

BRAC Sericulture in BANGLADESH


BRAC Sericulture
Background


BRAC played a pioneering role in the development of sericulture in the country and the Sericulture enterprise was established to engage the rural women in income-generating activities through mulberry cultivation, silkworm and seed production, reeling and spinning of silk yarn, and weaving and marketing silk.
Silkworm rearing is a labour intensive activity that is usually done at home, and silk is a high-value, low-volume commodity that is in demands both nationally and internationally. Sericulture has a large potential of being integrated with other agrarian systems based on household operation . Presently there is a demand for 360 tons of silk in Bangladesh.  However, only 60 tons of silk are produced each year out of which BRAC produces 40 tons. There is tremendous scope for growth in silk production.   
BRAC Sericulture today
In 1978, BRAC began its sericulture programme as part of the Manikganj Integrated Project. In 1996 the Environment Group at BRAC conducted an initial investigation of BRAC’s sericulture programme and found the sericulture programme and the activities of Ayesha Abed Foundation related to silk production to be socially and environmentally sustainable.The Sericulture program, now established as an enterprise, has since then been involved in aiding rural women with income generation and employment, tree plantation, soil conservation, village level nursery establishment, and silk production.  The Sericulture enterprise engages the rural women in a range of activities including, nursery, Mulberry plantation, silk worm egg supply, silk worm rearing for silk thread, reeling, weaving, printing and dyeing silk. BRAC Sericulture Enterprise is currently involved in introducing high yielding varieties of mulberry trees to areas in the north, which annually suffer from Monga or seasonal famine.
Quick Stats
BRAC Sericulture enterprise cultivated mulberry trees on 2,961 acres of landengaged 7,500 women in rearing silk worms and 5,800 women in spinning, and produced 25 metric tons of raw silk in 2008.

ইয়োকোহামা সিল্ক মিউজিয়াম

ইয়োকোহামা সিল্ক মিউজিয়াম







জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হচ্ছে ইয়োকোহামা। এটা সমুদ্রবন্দর। ১৮৫৯ সালে উন্মুক্ত হয়। প্রায় ২০০ বছরের স্ব-আরোপিত নিষিদ্ধ-রাজ্যের কপাট উন্মুক্তকরণের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয় জাপানে আধুনিকতার। বিগত ১৫০ বছরে য়োকোহামা মহানগরীর অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে সবদিক দিয়েই। এটি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত একটি বন্দরনগরী। নয়নাভিরাম এই বন্দরনগরে রয়েছে একাধিক জাদুঘর। যেমন য়োকোহামা আর্কাইভস অব হিস্ট্রি, য়োকোহামা ডল মিউজিয়াম, য়োকোহামা মিউজিয়াম অব য়োরোপিয়ান কালচার্স, দি জাপানিজ নিউজপেপার মিউজিয়াম, য়োকোহামা স্ট্রিট কার মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব য়োকোহামা আরবান হিস্ট্রি, য়োকোহামা মিউজিয়াম অব আর্ট, মিৎসুবিশি মিনাতো মিরাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়াম, নিপ্পন মারু মেমোরিয়াল পার্ক, সোগো মিউজিয়াম অব আর্ট, য়োকোহামা হিস্ট্রি মিউজিয়াম প্রভৃতি। এগুলো প্রমাণ করে য়োকোহামার সঙ্গে দেশ-বিদেশের সম্পর্ক কত হৃদ্ধ ছিল।

জাদুঘর সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতিচ্ছবি এবং মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আধ্যাত্দিক শকট। আঠারো থেকে বিশ শতকে এশিয়ার কলকাতা, হংকং, সাংহাই, পেনাঙ, জাভা, নাগাসাকি, কোবে এবং য়োকোহামার মধ্যে ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগ। একে বলা যায় সামুদ্রিক সিল্করোড। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও আরব বণিকদের প্রধান বাণিজ্যিক পথই ছিল এই সমুদ্রপথ। মসলা, খাদ্য, আফিম, ধাতবসামগ্রী, সুতা, মসলিন, কাঁচা সিল্ক ইত্যাদি ছিল প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য। কাজেই সিল্ক নিয়ে একটি মিউজিয়াম খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরেই। সেটা যে য়োকোহামাতে আছে তা জানতাম না।

গত বছর গ্রীষ্মকালে য়োকোহামাতে জাপান ভ্রমণরত ভারতের মণিপুর রাজ্যের একটি নৃত্যদল অনুষ্ঠান করতে আসে। আমন্ত্রণ পেয়ে যে ভবনে গেলাম সেটাই সিল্ক মিউজিয়াম। য়োকোহামা নগরীর নাকা-ওয়ার্ডে অবস্থিত এই জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে য়োকোহামা বন্দর উন্মুক্তির শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ১৯৫৯ সালে। যার বয়স এখন অর্ধশতাব্দী। জাদুঘরটি আধুনিককালে সিল্ক কীভাবে জাপানে বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে বিস্তার লাভ করল তাকে কেন্দ্র করে সজ্জিত হলেও একটা সিল্ক-সংস্কৃতি যে এদেশেও মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২) ও তাইশো যুগ (১৯১২-২৬) হয়ে শোওয়া যুগের (১৯২৬-৮৯) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল তার চিত্র এখানে পাওয়া যায়। তবে প্রাচীন ইতিহাস কিছু জানা যায় না। কবে সিল্ক জাপানে আমদানি হয়েছিল সে সম্পর্কে জানতে হলে গ্রন্থাগারেই যেতে হবে। তথাপি যেভাবে জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে তাতে করে স্পষ্টতই ধারণা হয় যে, সিল্ক জাপানের জন্য ছিল অপরিহার্য একটি বাণিজ্যিক উপাদান। সিল্ক দিয়ে তৈরি পণ্যসামগ্রী বহির্বিশ্বে রপ্তানির চিন্তা করেছে জাপান আঠারো শতকেই। ১৮৭৩ সালে ভিয়েনা শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় জাপান প্রথম সিল্কের রুমাল দিয়ে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। সেখানে জাপানি সিল্ক কারিগররা বিদেশে প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। সেই প্রযুক্তি জাপানও দ্রুত প্রয়োগ করে। তাছাড়া ব্রিটেনের কতিপয় সিল্ক পণ্য ব্যবসায়ীরাও আগ্রহ সহকারে য়োকোহামাতে ব্যবসা উন্মুক্ত করেন। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাপানি সিল্ক ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে হাত দেন। সিল্কের ব্র্যান্ড সামগ্রী তৈরি করে প্রভূত সাফল্য অর্জন করে কতিপয় প্রতিষ্ঠান। পণ্যের মধ্যে বড় রুমাল বা স্কার্ফ এখনো বিখ্যাত ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্ববাজারে বিদ্যমান। তারই নমুনাসমূহ এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিছু তথ্য খুঁজে পেয়ে আশ্চর্য হলাম যে, মধ্যযুগ তথা ১৬ শতকেই জাপানে 'বেঙ্গল সিল্ক' নামে অত্যন্ত উন্নতমানের কাঁচা সিল্ক জাপানে আমদানি এবং সমাদৃত হয়েছিল। দেশীয় বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়ে জাপানি সিল্ক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য এশিয়ার কোনো কোনো বাজারেও বিক্রি করতেন। কয়েক দশক পর্যন্ত এই সিল্ক আমদানি করে জাপান প্রভূত লাভবান হয়। তবে এই সিল্ক বাংলার কোন জায়গা থেকে আমদানি হতো বা কারা রপ্তানি করতেন গবেষণাসাপেক্ষ। সমুদ্রপথে পর্তুগিজ বা আরব বণিকরা এই ব্যবসা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। কলকাতার তাম্রলিপি বন্দর অথবা পূর্ববঙ্গের চাটগাঁ বা সাতগাঁ সমুদ্রবন্দর থেকে এই সিল্ক ক্রয় করে বণিকরা জাপানের নাগাসাকি সমুদ্রবন্দরে এনে বিক্রি করতেন। তখন জাপানে সামুরাই তথা এদো যুগের (১৬০৩-১৮৬৮) সূচনা হয়েছে। অথবা সিল্কের জন্মস্থান চীন থেকে বীজ নিয়ে বাংলা অঞ্চলে সিল্কের চাষাবাদ হওয়ার ফলে সিল্কপথ ধরেও জাপানে ওই বেঙ্গল সিল্ক প্রবেশ করে থাকতে পারে। এই সিল্ক জাদুঘরে আরও দেখতে পেলাম সিল্কের তৈরি শাড়ি কাপড়সহ নানা ধরনের পোশাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আছে রেশমগুটি থেকে সুতা তৈরির চরকা, কাপড় তৈরির তাঁত মেশিন, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং নানারকম পণ্যের নমুনা।

মহাশূন্যে ব্যাকটেরিয়া চাষ

মহাশূন্যে ব্যাকটেরিয়া চাষ
 ব্যাকটেরিয়া 


বিজ্ঞানীদের ধারণা, নদীর পানি বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে গিয়ে পরে ঘনীভূত হয়ে আবার নিচে নেমে আসার সময় মহাশূন্যের ব্যাকটেরিয়া পানিতে যুক্ত হয়ে নদীতে চলে এসেছে। গবেষকরা বলছেন, ওই ব্যাকটেরিয়া সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় দুই গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। মহাকাশে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া হতে পারে পৃথিবীতে ব্যবহারের জন্য শক্তির উৎস। গবেষকরা সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছেন। তারা বলছেন, যুক্তরাজ্যের নদীতে এ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোকে শক্তির উৎস হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ব্যাসিলাস স্ট্র্যাটোস্ফেরিকাস নামের ওই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত পৃথিবীর ২০ মাইল উপরে শূন্যে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সুন্ডারল্যান্ডে ওয়্যার নদীতে ওই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। মাইক্রোবিয়াল ফুয়েল সেল ধরনের বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি ব্যাটারির মাধ্যমে ওই ব্যাকটেরিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ ব্যাকটেরিয়া চাষ করা সম্ভব। আর এভাবে বিশ্বে শক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোগান বাড়ানোর অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। 

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রেশমের কথা

রেশমের কথা 


নব্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী সময়ে মানুষ চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করার পর থেকে সভ্যতার স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটে। লৌহ ও তাম্র যুগে অস্ত্র নির্মাণ, বাসন-কোসন, বস্ত্র ইত্যাদি প্রস্তুতে মনোযোগী হয়, মানুষ নিজেকে নানাভাবে সৌন্দর্য চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌন্দর্য বিকাশে মনোযোগী হয়। সৌন্দর্য বিকাশের সাধনায় নানা আবিষ্কার যেমন বাড়িঘর নির্মাণ, ব্যবহারিক বাসন-কোসন, পরিধেয় বস্ত্র, খাবারের নানা উপকরণ, যানবাহন ইত্যাদি, তেমনি ১৯২৯ সালের পর পেইচিং (বেইজিং) শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে চৌখতিয়ান নামক স্থানে মকর মানব নামে এক জাতি বাস করতো সময়কাল ছিল ভূগঠনের চতুর্থ যুগে। যারা ‘পিকিং মানব’ বা পেইচিং মানব নামে পরিচিত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে পীত নদীর অববাহিকায় পীত সভ্যতা নামে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। পীত সভ্যতা বলতে আধুনিক হোয়াংহু নদীর অববাহিকাকে বোঝায়, যা বেইজিং শহরের কাছাকাছি। এক সময়ে হোয়াংহুকে চীনের দুঃখ বলা হতো। পীত সভ্যতা বলতে চীন সভ্যতা বোঝায়। 
প্রাগৈতিহাসিক যুগের চীনের প্রাচীন গ্রন্থে নানা প্রকার উপাখ্যানের উল্লেখ আছে, এমনি একটি উপাখ্যানে ‘হুয়াংতি’ নামে এক সম্রাট ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী সম্রাট ছিলেন। তদানীন্তন নানা উপজাতিদের নিজের অধীনস্থ করেছিলেন। তার স্ত্রী ‘সম্রাজ্ঞী লেইজু’ সর্বপ্রথম রেশমগুটি থেকে সুতা তৈরি ও রেশম গুটিপোকার চাষ প্রবর্তন করেন। রেশমের আবিষ্কার প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে অতীত ইতিহাসের অংশটুকু প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়। ইতিহাসে ‘চৌ ডাইনেস্টি’ (১১২২ থেকে ২৫৫) খ্রিস্টপূর্ব চীনাদের স্বর্ণযুগ বলা যায়। চৌ ডাইনেস্টির আমলে পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস, লাওতেজ ও সুন্দর সিল্কের জন্ম ঘটে। চৌ ডাইনেস্টির পর ‘হান’ ডাইনেস্টির আমলে (২০৬ খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ খ্রিস্টাব্দে) মধ্য এশিয়া ও পারস্য ছাড়া চীনাদের তৈরি সিল্ক ও অন্যান্য সামগ্রী বাণিজ্যিক কারণে ইউরোপে (কেরাভেন) উটের সাহায্যে নেয়া হতো। উটের মাধ্যমে বাণিজ্যিক যাতায়াতের পথকে সিল্ক রোড হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তাছাড়া ভারত, সৌদি আরব, গ্রিস ও রোম সিল্কের জন্য একই পথ ব্যবহার করত। চীনারা সিল্কের বিনিময়ে মূল্যবান পাথর, আইভরি (হাতির দাঁত) খোদাইয়ের জন্য এবং ঘোড়া আমদানি করত।
সিল্ক রোড উদ্বোধনের আগে চীনাদের সংস্কৃতি আপন গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। সিল্ক রোডের ফসল হিসেবে চীনা সংস্কৃতি বিনিময়ের খোলা জানালা উন্মোচিত হয় যা পরবর্তী সময়ে চীনা সংস্কৃতির বিরাট পরিবর্তন ঘটায়। পরিবর্তনটি চীনাদের পোশাকে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ৭০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে তুর্কী ও মোগলদের আগমনের ফলে প্রাচীন চীনাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পরিবর্তে ‘কাফতান’ সরু হাতওয়ালা লম্বা কোট ব্যবহার শুরু করে। মুসলমানদের আবির্ভাবের আগে থেকে আরব বণিকেরা চীনের সঙ্গে সিল্কের ব্যবসা শুরু করে, বিনিময়ে সুগন্ধি আতর চীনাদের কাছে বিক্রি করে। আরবদের হেরেমে সিল্ক অত্যন্ত প্রিয় ছিল, কারণ ঝলসানো রংয়ে চীনাদের সিল্ক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
চীনাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হলেও সিল্কের ক্ষেত্রে কোনো যান্ত্রিকতার ব্যবহার করেনি। সম্পূর্ণ হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে সিল্ক বস্ত্র তৈরি করা হতো। তারা সিল্ক তৈরি ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় তাঁতে সিল্ক তৈরি করত। এমনকি চীনারা সিল্কের এই গুরু রহস্য কাউকে জানতেও দিত না। যদি কেউ সিল্ক তৈরি পদ্ধতি প্রকাশ করত, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
আরব বণিকেরা সিল্কের গুরু রহস্য চীনাদের কাছ থেকে জেনে দক্ষিণ তিউনেশিয়ায় গুটিপোকার চাষাবাদ শুরু করে।
চীনারা প্রাথমিক যুগে তন্তু দ্বারা তৈরি কাপড়, চামড়া বা সুতি কাপড় ব্যবহার করতো শীতকালে ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্য, মোটা কাপড় অথবা চামড়া দ্বারা তৈরি জ্যাকেটের মাধ্যমে। সিল্কের উদ্ভাবনের পর চীনা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের পারিবারিক পোশাকে উজ্জ্বল রংয়ের সিল্কের কাপড় ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া সিল্কের নকশি করা দড়ির মাধ্যমে তাদের অবস্থান ও মর্যাদা নির্ধারণ করা হতো।
একই সময়ে মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উত্সবের পোশাক হিসেবে গৃহীত হতো সিল্ক। চাইনিজ সিল্ক আরবদের কাছেও একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাকে পরিণত হয়। ধনী আরবদের কাছে সিল্ক সম্মানজনক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সিল্কের সঙ্গে হীরা-জহরতের ঔজ্জ্বল্যের সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয় যা আরবদের অত্যন্ত পছন্দ। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মীয় আচারে সিল্ক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। 
কথিত আছে, একটি সূক্ষ্ম বুননের মূল্যবান সিল্ক বস্ত্রখণ্ড রক্ষিত আছে, যা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো, যা কেবল রাজকুমারীর দেখার অধিকার আছে। কোনো বিদেশি রাজকুমারীর চীনে আগমন ঘটলে তাদের রেশম গুটিপোকা উপহার হিসেবে দেয়া হতো। বিভিন্ন লিখিত তথ্যে জানা যায়, আরবরাই এক সময়ে পৃথিবীতে সিল্কের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। তাছাড়া আরবদের পোশাকের ক্ষেত্রে চীনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; চীনারা আরবদের জন্য সিল্ক মজুত করে রাখত। সিল্ক ছাড়া মূল্যবান হীরক ঝলসানো নানারকম দামি পাথর ও মসলা এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে যেত।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিকদের ভারত বিজয়ের পর হিন্দুস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত প্রতিবেশী ইরানের অঙ্গীভূত হয়। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার কর্তৃক ভারত আক্রান্ত হয়। সিন্ধু সভ্যতা আলেকজান্ডারের নিয়ন্ত্রণে আসে। ভূমধ্যসাগর আশপাশের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে ভারতের সঙ্গে মসলিন, সিল্ক চাদর, খোদাইকৃত হাতির দাঁতের তৈজসপত্র, মূল্যবান পাথর চীন, ব্যাবিলন ও গ্রিসের সঙ্গে বিনিময় ব্যবসা স্থাপিত হয়। ভারতের বিশেষ করে কাশ্মীর অঞ্চল সিল্ক ও পশমি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাছাড়া ভারতের হায়দরাবাদ, লক্ষ্মৌ, পাঞ্জাব, বেনারস ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সিল্কের জন্য খ্যাত। গত পাঁচ হাজার বছর ধরে এই সিল্ক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হয়ে আসছে। 
চীন ও ভারত ছাড়া থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ বর্তমানে সিল্কের জন্য খ্যাত।
ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীর পরে সিল্ক রোডের মাধ্যমে, যা মধ্য চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। এই দুর্গম সিল্ক রোডটি হান ডাইনেস্টির আমলে ‘জাং কুইয়া’ নামক পূর্ব চীনের ব্যবসায়ী আবিষ্কার করেন। তার কিছুকাল পর জিন ডাইনেস্টির আমলে ফান হিয়েন। তুং ডাইনেস্টির আমলে ‘জিয়ান জং’ এবং ইতালীয় পর্যটক মার্কো পলো ভারত এসেছিলেন। তাছাড়া ‘ফাহিয়ান’ ‘জেকবদি এনকোলা’ একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী, মার্কো পলো এবং মরক্কো রাজ্যের পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই নৌপথটিও সিল্ক জলরোড হিসেবে পরিচিত। চীনের মিং ডাইনেস্টির আমলে সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার বাংলাদেশে দু’বার ভ্রমণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের এই পথটি দক্ষিণ অঞ্চলের তৃতীয় সিল্ক রোড নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সঙ্গে এই সিল্ক রোডটি স্থাপিত হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের সম্পর্ক প্রায় ২৪০০ বছরের। হান ডাইনেস্টির বিখ্যাত ঐতিহাসিকের লেখার মাধ্যমে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম সিল্ক রোড দক্ষিণ সিল্ক রোডের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এর যোগাযোগ ছিল। ব্যাকটেরিয়া বর্তমানের আফগানিস্তান। উত্তর হিন্দুকুশ পর্বতমালার পাদদেশ দিয়ে এই পথটি মধ্য এশিয়া ও ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জিং কোফং নামক এই ঐতিহাসিক উত্তর হিন্দুকুশ পর্বতমালার এ পথ ধরে মধ্য এশিয়া ভ্রমণ শেষে ব্যাকটেরিয়ায় ফেরত আসেন। চীন থেকে এর দূরত্ব ছিল প্রায় ৬ হাজার মাইল। বাংলাদেশের সোনারগাঁ, ঢাকা অঞ্চলের বিখ্যাত মসলিন এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপ হয়ে পারস্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। ফলে বাংলাদেশেও শিল্প উত্পাদন প্রায় কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশে সিল্কের উত্পাদন এখন কিছুটা কমে গেলেও অতীতে সিল্ক, মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি শাড়ি ও কাপড় ঢাকার আশপাশে তৈরি হতো। পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন কাপড়ও এখানে তৈরি হতো, যা এখন আর তৈরি হচ্ছে না। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিল্ক ও গুটিপোকার চাষ প্রচলিত ছিল। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চল ছাড়া তেমন কোনো অঞ্চলে রেশম বা সিল্কের চাষ দেখা যায় না। ১৯৫৬ সালের দিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ অঞ্চলে অত্যন্ত উন্নতমানের সিল্ক সুতা ও সিল্ক কাপড় উত্পন্ন হতো। সেখানে গুটিপোকার বিরাট খামার ছিল। বাংলাদেশের রাজশাহী ছাড়া বগুড়া, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে সিল্ক উত্পন্ন হতো। বাংলাদেশে সাধারণত হ্যান্ডলুমের মাধ্যমে সিল্ক উত্পাদিত হয়ে আসছে।
থাইল্যান্ড, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে বাংলাদেশ সিল্ক উত্পাদনে বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান করে নিতে পারত।
মসলিন, জামদানি, টাঙ্গাইল ও ঢাকাই শাড়ির মতো মধ্যযুগে পৃথিবীব্যাপী যে সুনাম আমরা অর্জন করেছিলাম তা অক্ষুণ্ন থাকত। আসুন আমরা সবাই মিলে হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করি।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীতে রেশম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন



অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীতে রেশম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন




১৮৬১ সালে এ দেশে তিনজন বিখ্যাত বাঙালির জন্ম হয়, তাঁরা ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়। এ বছর এ তিনজনের জন্মের সার্ধশততম বছর উত্তীর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উভয় বাংলায় অনেক আয়োজন হয়েছে, প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে ওই বাংলায় কিছু কিছু আয়োজন হয়েছে, কিন্তু অক্ষয়কুমার দুই বাংলাতেই অগোচরে থেকে গেছেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বাংলা ভাষায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চার প্রবক্তা। তিনি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, সুসাহিত্যিক, নাট্যানুরাগী, সম্পাদক, সমাজসেবক হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু এর বাইরেও তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তা আমাদের অনেকেরই অজানা। দুটি ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র অবদান নিচে উল্লেখ করলাম। 

অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও বাঙালি পল্টন 
ইংরেজ শাসনামলে বাঙালিকে অসামরিক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সরলাদেবীসহ আরও অনেকে লেখনী, যুদ্ধে যোগদানের আগ্রহ, অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অসামরিক জাতির কলঙ্ক ঘোচানোর চেষ্টা করেন। এতে বিশেষ ফল লাভ না হলেও প্রথম মহাযুদ্ধকালে বাঙালির জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ আসে। বাঙালির প্রবল সামাজিক আন্দোলনের ফলস্বরূপ গঠিত হয় ‘বাঙালি পল্টন’, যার নাম ছিল ‘ফর্টিনাইনথ্ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’। যেসব বাঙালি নেতার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং প্রচেষ্টার ফলে বাঙালি পল্টন গঠন হয়েছিল, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
১৯১৬ সালে গঠিত বাঙালি পল্টনের সফলতার জন্য বাংলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দেন। তাঁরা এর সফলতার জন্য কলকাতায় ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটি’ নামের একটি বেসামরিক সংস্থা গঠন করেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটির প্রধান দায়িত্ব ছিল বাঙালি পল্টনে যোগদানের জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা, সৈনিক ভর্তিতে সরকারকে সহযোগিতা করা, এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমিটি প্রতি জেলায় একজনকে পল্টন গঠনে সহযোগিতা করার দায়িত্ব দেয়। রাজশাহীতে পল্টন গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, তাঁর নাম ১৯১৬ সালের ২৯ আগস্ট দ্য বেঙ্গলি পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রাজশাহীতে বাঙালি পল্টন গঠনে সহযোগিতা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যকেও বাঙালি পল্টনে যোগদানের অনুমতি দেন। মনবাহাদুর সিংহ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র দত্তক পুত্র ছিলেন। ১৯১৬ সালের আগস্ট মাসে মনবাহাদুর কলকাতায় এসে বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। চাকরিকালে মনবাহাদুর ভারতীয় কমিশন পান এবং সুবেদার (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ) পদে উন্নীত হন।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে বাঙালির সামরিক ইতিহাস নিয়ে রাজেন্দ্রলাল আচার্য ‘বাঙালির বল’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থে বাঙালি পল্টনসহ বাঙালির বিভিন্ন সময়ের সামরিক অর্জন বা কৃতিত্ব তুলে ধরেন। গ্রন্থে অক্ষয়কুমারের মন্তব্য সংযোজন করা হয়। তিনি উল্লেখ করেন, ‘যিনি এই বহু তথ্যপূর্ণ বৃহৎ গ্রন্থ আদ্যন্ত পাঠ করিবেন, তিনিই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিবেন, ইহাতে জানিবার ও ভাবিবার কথার অভাব নাই। কি সেকালে কি একালে কোনো কালেই বাঙ্গালীর বাহুবলের অভাব থাকা স্বীকার করা যায় না। বিগত জগদ্ব্যাপী মহাযুদ্ধেও বাঙ্গালী বাহুবলের পরিচয় দিয়া সমগ্র সভ্য সমাজের নিকট পুনঃ পুনঃ প্রশংসা লাভ করিয়াছে।.......যাঁহারা দেশের লোক, দেশের অভ্যুত্থানের জন্য আগ্রহপূর্ণ, তাঁহারা অবশ্যই এরূপ গ্রন্থের সমাদর করিতে ক্রটি করিবেন না। এই শ্রেণীর গ্রন্থ সঙ্কলনের প্রয়োজন আছে। একখানি গ্রন্থে সে প্রয়োজন পর্যাপ্তরূপে সিদ্ধ হইয়া যায় নাই।’

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও প্রযুক্তি 
অক্ষয়কুমার বাংলাদেশে প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি ইউরোপের শিল্পবিপ্লব এবং তাদের উন্নতি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক শিল্প বা কলকারখানা প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশের বিশেষ কোনো উন্নতি হবে না। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজশাহী রেশম শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এ সময় বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় রাজশাহী থেকে রেশম রপ্তানি হতো। ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিসহ বহিরাগত অনেকেই রাজশাহীতে রেশম ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উন্নত প্রযুক্তির অভাবে রাজশাহীর রেশম চাষ ও শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, রপ্তানিও কমতে থাকে। অক্ষয়কুমার এই অবস্থার উন্নতিকল্পে জেলা পরিষদের সহযোগিতায় এবং স্থানীয় জমিদারদের আর্থিক অনুদানে রাজশাহীতে ১৮৯৮ সালে একটি রেশম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অক্ষয়কুমার নিজে রেশম স্কুলের সম্পাদক ও শিক্ষক ছিলেন। কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত সীতানাথ গুহ ছিলেন প্রধান শিক্ষক। উভয়ের প্রচেষ্টায় স্কুলের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ স্কুলে গুটিপোকার উন্নত বীজ এবং তা থেকে সুতা প্রস্তুত, সুতা রং করে বস্ত্র তৈরির নতুন প্রযুক্তি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হতো। রেশম স্কুলের সাহায্যে অদক্ষ শ্রমিকদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে দক্ষ বা যুগোপযোগী করে তোলা হতো। বিদ্যালয়ের সফলতায় রাজশাহী থেকে গুটিপোকার বীজ রপ্তানি বেড়ে যায়, এখান থেকে জাপান, ইতালি, ইংল্যান্ড এবং উপমহাদেশের নানা স্থানে বীজের চালান যেতে থাকে। অযোধ্যার মহারাজ রামপাল সিং পণ্ডিত শীতল প্রসাদ উপাধ্যায়কে এ বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান, ফিরে গিয়ে শীতলপ্রসাদ অযোধ্যায় নয়টি রেশম কারখানা চালু করেন। অক্ষয়কুমার শিল্পে প্রযুক্তির প্রয়োগ বিষয়ে তখনকার পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালিখি করেন। রেশম শিল্পের উন্নয়ন এবং জাতীয় শিল্পের বিস্তারে অক্ষয়কুমারের দৃষ্টান্তে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রেশম চাষ শুরু করেন, যদিও উদ্যোগটি বেশি দূর এগোতে পারেনি। তবে রশম স্কুলের ধারণা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনে বয়ন বিদ্যালয় চালু করেন।
অক্ষয়কুমারের প্রযুক্তি বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের জন্য সারা ভারতে স্বীকৃত হন। ১৯০০ সালের ৩১ জানুয়ারি হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকায় প্রকাশিত নিচের সংবাদটি এই স্বীকৃতির উত্তম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হলো।
তাতার প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্ষয় বাবু। পার্শী ধনকুবের মিঃ জেমশেঠজী তাতা একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থাপনের জন্য গবর্মেন্টের হাতে ৩০ লক্ষ টাকা প্রদান করিয়াছেন। উক্ত বিদ্যালয়ে কি প্রণালীতে শিক্ষাদান আবশ্যক, তা সম্বন্ধে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর শ্রীযুক্ত পেডলার সাহেব রাজশাহী সেরিকালচারাল স্কুলের মাননীয় শিল্প......[অস্পষ্ট] শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্র বি, এল মহাশয়ের অভিমত জানিতে চাহিয়াছেন। তিনি শীঘ্রই তাহার অশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ সুদীর্ঘ মন্তব্য গবর্মেন্টের সমীপে পেশ করিবেন। আমরা তাহার মতামতের সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম সঙ্কলন করিতেছি, বরান্তরে তাহার অবিকল অনূদিত পাঠ উদ্ধার করিবার ইচ্ছা রহিল:-
“আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবকদের জ্ঞান কার্য্যক্ষেত্রে প্রকাশিত হইবার অবসর পায় না তাহার প্রধান কারণ যে, তাহাদের সে জ্ঞান শুধু কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহাতে চর্চ্চা রাখিবার উপায় নাই। যদিও বা দুই এক জন কোন নতুন শিক্ষা তত্ত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হন। কিন্তু তাহার আনুসাঙ্গিক অবশ্য প্রয়োজনীয় কলকারখানাদির অভাবে তিনি তাহা শুধু লেখনী মুখে ব্যক্ত করিয়াই জ্ঞানতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেন। জ্বদিচ সে নবাবিস্কৃত তত্ত্ব বৈদেশিক শিল্প ব্যবসায়ীর হস্তে পড়িয়া তাহাদের ধনাগমের পথ সুপ্রশস্ত এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিরুৎসাহী ও দারিদ্র্যাবর্দ্ধন করিয়া থাকে। আমাদের মস্তিষ্কের ফল তাহারা উদারে উপভোগ করেন।
ইউরোপের জার্ম্মানী, সুইজারল্যান্ড গভর্নমেন্ট যেমন তত্রত্য অধিবাসীবৃন্দকে “হাতে কলমে” শিক্ষাদান করিয়া থাকেন, তোমাদেরও [ভারত গভর্নমেন্ট] কর্তব্য আমাদিগকে সেই প্রণালীতে শিক্ষাদান করা। পূর্বাপর আমাদের ঈদৃশ অনুযোগের উত্তরে তোমরা টাকার অভাব প্রদর্শন করিয়া আমাদের মুখবন্ধ করিয়াছিলে। কিন্তু এখন সে আপত্তি করিলে চলিবে না। আমাদেরই একজন স্বদেশ বন্ধু এই সৎকার্য্য জন্য বহু লক্ষ টাকা প্রদান করিতেছেন। এ অর্থ যদি কেবল কলমের কুফল প্রসবিনী শিক্ষাতেই ব্যয়িত হয় তবে মনে করিতে হইবে তাহার অসদ্ব্যবহার হইয়াছে। আপাতত আমাদের দেশে একদেশদর্শিনী লেখনী-শিক্ষায় কোনো ফল হইবে না। কলম-জ্ঞান আমাদের যথেষ্ট হইয়াছে—অন্ততঃ যে টুকু হইয়াছে তাহাতেই হাতের কার্য্য কিছু কিঞ্চিৎ চলিতে পারে। [এস্থলে অক্ষয় বাবু, আত্ম-অভিজ্ঞতা হইতে দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিয়াছেন]। আমি নিজে অতি সামান্য সামান্য যন্ত্র ও দ্রব্য সংযোগে যে সকল রাসায়নিক বর্ণবৈচিত্র এবং সুমেদুর কৌষেয়-তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছি। তাহা হইতে কলমের জ্ঞান যে আমাদের যৎ-সামান্যও নাই তাহা বুঝা যায় না। পরন্তু, সুবৃহৎ যন্ত্রাদি এবং সুপ্রশস্ত কারখানা পাইলে, এই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারাই অনেক বেশি কার্য্য এবং দেশের প্রভূত ধনাগমের আনুকূল্য করা যাইতে পারে। সুতরাং এই প্রকৃষ্ট প্রণালীতে শিক্ষাদান আমি সর্ব্বতোভাবে গৃহিত বিবেচনা করি এবং গভর্নমেন্টকে নির্ব্বান্ধাতিশয্য সহকারে অনুরোধ করি।” 
ইত্যাদি—
শ্রীযুক্ত অক্ষয়বাবুর নির্ভীক লেখনী, কি রাজনৈতিক কি ঐতিহাসিক কি ক্ষেম ক্ষেমতায় সর্ব্ব বিষয়েই আমাদের রাজসাহীর গৌরবস্থানীয় আশা করি গবর্মেন্ট এরূপ সুবিজ্ঞ ব্যক্তির বক্তব্যগুলো পালন করিতে অবহিত হইবেন।
বাংলাদেশে তো বটেই, সারা ভারতেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র মতো প্রতিভাধর বাঙালি বিরল। অথচ তাঁর মৃত্যুর ৮০ বছর পরও এ দেশে তাঁর কোনো স্বীকৃতি মেলেনি, সার্ধশততম বছরেও কেউ তাঁকে স্মরণ করেনি।

আমার দেখা ৪টি দেশ আর কিছু অভিজ্ঞতা

আমার দেখা ৪টি দেশ আর কিছু অভিজ্ঞতা
ড. অর্ধেন্দু শেখর রায় (পি এস , বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী)



১৩ দিনে কানেক্টিং ফ্লাইটসহ ১২ বার বিমানে ওঠানামা অনেকটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়, তাই না! কিন্তু বাস্তবে এমনই একটি ভ্রমণ করতে হয়েছে গত ১৪ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব জনাব আশরাফুল মকবুলের নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি টিম রেশম শিল্পের উন্নয়ন এবং এর সর্বশেষ অবস্থা সরেজমিনে দেখা ও জানার জন্য চীন, জাপান, ভিয়েতনাম এবং ভারতের ব্যাঙ্গালোর সফর করা হয়। 
টিমের অন্য সদস্যরা হলেন:
(১) সুনিল চন্দ্র পাল, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড 
(২) মোঃ ইমদাদুল হক, যুগ্ন-সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
(৩) মোঃ সাইফুল আলম হামিদী, যুগ্ম-প্রধান, পরিকল্পনা কমিশন 
(৪) মোঃ মনছুরুল আলম, উপ-প্রধান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
(৫) মোঃ আব্দুল হামিদ মিয়া, পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট 
(৬) মোঃ আমজাদ হোসেন, পরিচালক, আইএমইডি 
(৭) শেখ আখতার হোসেন, পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় 
(৮) মোঃ মোরতোজা রেজা, চীফ প্লানিং, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড 
(৯) আলাউদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, সিল্ক ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন। 

উক্ত টিমের ১ জন সদস্য হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। মাননীয় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমাকে এ ধরনের একটি সুযোগ করে দেয়ার জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ৪ দেশের এই সফরে দু’একটি ঘটনা বাদে পুরোটাই ছিল আনন্দদায়ক, সুখকর, মজার এবং সর্বোপরি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। চীনে মাইনাস টোয়েন্টি এবং জাপানে মাইনাস টেন পর্যন্ত তাপমাত্রায় আমরা অবস্থান করেছি। ভিয়েতনাম এবং ভারতে মোটামোটি সহনীয় তাপমাত্রা ছিল।

১৪ জানুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিমান ছাড়ে। তারপর চীনের কুনমিং হয়ে স্থানীয় সময় রাত ১২টার দিকে বেইজিং বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের বেইজিং শহরের কেন্দ্রস্থলে সিটি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে আনুষঙ্গিক কার্যাদি সম্পন্ন করে রাত ২টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন ১৫ জানুয়ারি সকালে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের ১টি, চীনের প্রাচীর দেখার জন্য আমরা রওনা হই। তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস টোয়েন্টি। প্রাচীরের পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিষয়টি অতটা বুঝে উঠতে পারিনি। বাতাস বইছিল তীব্র বেগে। প্রাচীরে ওঠার ৫/১০ মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং বাতাসের বেগে আমরা কেউ-ই আর হাঁটতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল প্রচন্ড ঠাণ্ডায় আমরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আমাদের মধ্য থেকে কে যেন বলছিল “স্যার, চলেন নেমে পড়ি”। প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে নেমে পড়লাম এবং নিচে আরও প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পর একটা রেস্তোরাঁয় আশ্রয় নিলাম। রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর মনে হচ্ছিল এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে লক্ষ্য করলাম সবাই আমার মতো রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেছে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে স্যুপ খেয়ে আবার বেইজিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রাচীর দর্শনের সেই স্মৃতি সারাজীবন মনে থাকবে। বিকেলে সবাই মিলে একটা ছোট্ট মার্কেটে গেলাম। কিছুক্ষণ টুকটাক শপিং করে ফেরার পথে দূর থেকে তিয়েন মেন স্কোয়ার দেখি এবং আমাদের সাথে যিনি গাইড ছিলেন তিনি দূর থেকে মাও সেতুং-এর মরদেহ যে ভবনে সংরক্ষিত আছে সে ভবনটি দেখান। তারপর গাইডের সহায়তায় একটা বাঙালি হোটেলে সন্ধ্যায় তৃপ্তিসহকারে খাবার খেয়ে পুনরায় আরও একটি সিল্ক মার্কেটে যাই এবং ঘণ্টা দুয়েক ছোট খাটো শপিং শেষ করে হোটেলে ফিরলাম। 

পরদিন ১৬ জানুয়ারি আমাদের টিম চংকিংয়ের উদ্দেশ্যে বেইজিং ত্যাগ করে। সাংহাই হয়ে কানেক্টিং ফ্লাইটে চংকিং পৌঁছি সন্ধ্যার দিকে। চংকিং শহরের কেন্দ্রে YUDU হোটেলের ২৬ তলার বিভিন্ন কক্ষে আমরা অবস্থান করি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের ১১ জনের টিমে ১ জন বাদে (জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ) বাকী ১০ জনের জন্যই ছিল এটা প্রথম চীন সফর। প্রথমদিন যখন বেইজিং শহর দেখলাম তখন এর চোখ ধাঁধানো উন্নতি দেখে আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যেদিকে তাকাই আধুনিক এবং পরিকল্পিত সু-উচ্চ ইমারত। শহরের যতটুকু অংশ ঘুরেছি তাকিয়ে শুধু বিমোহিত হয়েছি। তখন মনে মনে ধারণা করেছি বেইজিং শহরের সাম্প্রতিক এতটা উন্নতির কারণ হয়তো বা গত বেইজিং অলিম্পিক। কিন্তু সে ধারণা ভাঙলো চংকিং শহরে গিয়ে। বিখ্যাত ইয়াংসি নদীর তীরের এই শহরটিকে ‘মিনি হংকং’ বলা হয়ে থাকে। সেই শহরের একজন মহিলা Mrs. খবর (যিনি আমাদের টিমের সদস্য জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ-এর পূর্ব পরিচিত) ১৭ জানুয়ারি রাতের বেলায় আমাদের কয়েকজনকে শহরটি ঘুরিয়ে দেখান। আমি, আলাউদ্দিন ভাই, মনসুর এবং সেই মহিলা রাতে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শহরটিকে প্রত্যক্ষ করলাম। কী সুন্দর যে লাগছিলো বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। শুধু নদীর পাড়ই নয় শহরের যতটুকু অংশ দেখেছি তাতে মনে হয়েছিল এটি বেইজিং-এর চেয়েও উন্নত। তার মানে শুধু বেইজিং নয় পুরো চীনেরই অভুতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। তার আগে সকালে আমাদের টিম-এর একাংশ মাননীয় সচিব-এর নেতৃত্বে ‘চায়না সিল্ক মেটেরিয়ালস’ এবং ‘ফেব্রিক্স ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কর্পোরেশন’ পরিদর্শন করেন এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেন। বিকেলে একটি সিল্ক রিলিং ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করা হয়। উক্ত ফ্যাক্টরির মালিক জনাব ঝং চেং-এর কাছ থেকে চীনে রেশম-এর আবিষ্কার এবং এর ব্যবহারের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। বিশ্বে রেশম উৎপাদনে চীনের স্থান হচ্ছে সবার উপরে। প্রায় ৩৬,০০০ মেট্রিক টন। রপ্তানিতেও দেশটি সবার উপরে।

১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে আমরা হোটেল ত্যাগ করি জাপানের উদ্দেশ্যে। আবার সাংহাই হয়ে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটায় টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন টোকিওতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম এবং আমাদের টিম মেম্বার জনাব মোঃ মনসুরুল আলম-এর ভাগ্নে জনাব মোঃ সানাউল হক। চার দেশের সফরে চার রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এর মধ্যে জাপানের অভিজ্ঞতা ছিল মধুর এবং প্রাণবন্ত। অনেকের সংস্পর্শেই এসেছি। তারপরও জনাব সানাউল-এর সান্নিধ্য ছিল স্মরণীয়। তিন দিনের জাপান সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমাদের একান্ত সহচর। যাইহোক, এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে করে টোকিওতে এসে Mystay Ochanomizu হোটেলে মালামাল রেখে সানাউল আমাদেরকে একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন এবং ডিনার করালেন। তারই সহযোগিতায় পরদিন অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি বুলেট ট্রেনে করে হিরোশিমার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। টোকিও স্টেশন থেকে নজুমা সুপার এক্সপ্রেসে (বুলেট ট্রেনের নাম) চড়লাম। সকাল ৭:১০ মিনিটে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো ২৭০ কিঃ মিঃ বেগে। টোকিও থেকে হিরোশিমার দূরত্ব ৮৯৪ কিঃ মিঃ। মাঝপথে ৬/৭টি স্টেশনে বিরতি ছিল। আমরা ঠিক ১১:১০ মিনিটে হিরোশিমা স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখানে আমাদেরকে রিসিভ করলেন কক্সবাজারের মেয়ে এ্যানি। সত্যি, কি মধুর স্মৃতি! মেয়েটি সানাউলের পরিচিত। পুরোটা সময় তিনি যেভাবে আমাদের সঙ্গ দিলেন তাতে মনে হচ্ছিলো আমরা তার পরিবারেরই সদস্য। কি আন্তরিকতা! মেয়েটির স্বামী হিরোশিমায় চাকরি করে এবং মেয়েটি সেখানে পিএইচডি করছে বলে জানা যায়। যে উদ্দেশ্যে হিরোশিমায় যাওয়া সেই বোমা বর্ষণের স্থানে এ্যানি আমাদের নিয়ে গেলেন। 
জানা যায়, বোমাবর্ষণকালে হিরোশিমার উল্লেখযোগ্য শিল্প ও সামরিক গুরুত্ব ছিল। হিরোশিমার কাছাকাছি কয়েকটি সামরিক স্থাপনা ছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পঞ্চম ডিভিশনের সদর দপ্তর এবং ফিল্ড মার্শাল জাতার নেতৃত্বাধীন সেকেন্ড জেনারেল আর্মি হেড হেডকোয়ার্টার্স, যা পুরো দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপানের প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতো। হিরোশিমা ছিল জাপানি সামরিক বাহিনীর একটি প্রধান সরবরাহ ও লজিস্টিক ঘাঁটি। শহরটি ছিল একটি যোগাযোগ ও মজুত কেন্দ্র এবং সৈন্যদের সমবেত হওয়ার স্থান। জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী এই বোমা নিক্ষেপ করে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮:১৫ মিনিটে মানবজাতির বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রথম এ্যাটম বোমাটি বিস্ফোরিত হয় জাপানের এই স্থানে। তাৎক্ষণিক নিহত হয় ১ লাখ ২০ হাজার লোক এবং পরে প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ। বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। বিমানের চালক কর্নেল পল টিবেটস-এর মায়ের নামে বি-২৯ বিমানটির নামকরণ করা হয় ‘এনোলা গে’ যার নম্বর ছিল ৪৪-৮৬২৯২ এবং বোমাটির নাম ছিল ‘লিটল বয়’। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ফুট উঁচুতে ১৩ কিলোটিন শক্তিতে ‘লিটল বয়’ বিস্ফোরিত হয়।

হিরোশিমায় আনবিক বোমাবর্ষণ কত ভয়ংকর ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আনবিক বোমা নিক্ষেপের ১৬ ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস এই ঘটনা সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়। বিস্ফোরণের পর যারা জীবিত ছিলেন তাদের আনুমানিক ১ শতাংশ মানুষ বিস্ফোরণ পরবর্তী তেজষ্ক্রিয়তায় মারা যায়। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত হিরোশিমায় আনবিক বোমাবর্ষণে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬২ জন। তবে তাদের মধ্যে বোমার প্রতিক্রিয়ায় কতজন মারা গেছে তা ছিল অস্পষ্ট। ২০০৪ সালের শেষ নাগাদ জাপানে বোমায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার। 

বোমাবর্ষণস্থানে আমাদের টিমের সকল সদস্য কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমরা গেলাম হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে। এর দুটি অংশ। পূর্ব এবং মূল অংশ। পূর্ব ভবনে দেখানো হয় বোমাবর্ষণের পূর্বের হিরোশিমা শহর এবং বোমাবর্ষণের পরের হিরোশিমা শহর। মূল ভবনে দেখানো হয় এ্যাটম বোমা এবং যুদ্ধ বিমানসমূহ।

হিরোশিমার পর ঘণ্টাখানের ট্রামপথ পাড়ি দিয়ে এ্যানি আমাদের নিয়ে গেলেন মিয়াজিমা আইল্যান্ডে। স্টিমারে করে আইল্যান্ড পার হলাম। বিকেল বেলা কি অপূর্ব মনোরম দৃশ্য! মনের অজান্তেই আনন্দে গান গাইতে শুরু করলাম “আমি বন্ধু প্রেমে হইলাম পাগল” আর অমনি সানাউল তার হাতের ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে গানটি বন্দী করে ফেললো। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক শেখ আখতার হোসেন। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেক থেকে আবার স্টিমারে করে এপারে চলে আসলাম এবং ট্রেনে করে হিরোশিমা হয়ে আবার টোকিও চলে আসলাম। এসে খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ২টা বেজে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন হিরোশিমা যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ফুজিকে (৩৭৭৬ মিটার) দেখা গেছে। পুরো রাস্তার দু’দিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। হিরোশিমার স্মৃতি কোনোদিনও ভুলবো না। এ্যানিকে অসংখ্য ধন্যবাদ পুরো সময় আমাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।

পরদিন অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ৯:৩০ টায় আমরা Gurma Prefeeture-য়ে Silkworm Fiber Technology Center পরিদর্শন করি এবং পরিচালক Mr. Machida-র সাথে সচিব মহোদয় রেশম সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেন। পরে Tamioka-তে সিল্ক প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করি। আমাদের সাথে পুরোটা সময় ছিলেন জনাব রাশিদুল হাসান ও একজন জাপানি দো-ভাষী মি. সাসাকী।

পরিদর্শন শেষে আমরা যাই শপিং করতে বিখ্যাত একটি শপিং মলে। সেখানে টুকটাক শপিং শেষে যাই মি. সানাউলের অফিসে। সানাউল হক্ সাদিয়াটেক কোঃ লিঃ-এর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘দশদিক’-এর সম্পাদক। তিনি আমাদের সাথে তার অফিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার কার্যক্রম আমাদের সামনে তুলে ধরেন। আমাদেরকে বিভিন্ন ধরণের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন এবং পরিশেষে তাঁর পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। জনাব সানাউল দুই পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর অকৃত্রিম এবং আন্তরিক ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ। আমরা সবাই তার উন্নতি কামনা করি।

সন্ধ্যায় জাপানে বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব মজিবর রহমান ভূঁইয়া আমাদের টিমকে তার বাসভবনে ডিনারে আপ্যায়িত করেন। আমাদের টিম ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় দূতাবাসের ইকনমিক মিনিস্টার জনাব এ.কে.এম মানজুরুল হক, এনডিসি, কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম এবং প্রথম সচিব জনাব মোঃ নাজমুল হুদা। মান্যবর রাষ্ট্রদূত যে আন্তরিকতার সাথে আমাদের দেশীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করেছেন সেজন্য আমরা গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ। রাতে হোটেলে আসেন আমাদের সচিব স্যারের প্রাক্তন একান্ত সচিব ড. মোকছেদ এবং টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান (নাহিদ)। মোকছেদ পূর্বপরিচিত হওয়ায় তাঁকে পেয়ে খুব ভাল লাগছিল। নাহিদ ছেলেটা খুব প্রাণবন্ত ও আন্তরিক। তাঁকে আমার খুব ভাল লেগেছে।

২১ জানুয়ারি সকাল ৯:০০টায় আমরা হোটেল ত্যাগ করি। ১০:০০টায় আমরা জাপান সিল্ক এসোসিয়েশন পরিদর্শন করি। সেখানে সচিব মহোদয় ও রেশম বোর্ডের কর্মকর্তাগণ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাগণের সাথে আলোচনা করেন। সেখানে আমরা জানতে পারি জাপানে ধীরে ধীরে তুঁত চাষের ফলন কিভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে রেশম উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সিংহভাগ তারা আমদানী করে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। পরবর্তীতে আমরা জাপান সিল্ক সেন্টারে বিভিন্ন দ্রব্যাদি পরিদর্শন করি।
তারপর ১৯৫৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘টোকিও টাওয়ার’ দেখতে যাই যার উচ্চতা ৩৩৮ ফুট। টাওয়ারটি দেখতে খুবই সুন্দর। অনেকটা আইফেল টাওয়ারের আদলেই তৈরি। টাওয়ার ভবনে কিছু টুকটাক সদাই করে লাঞ্চ কিনে গাড়িতে বসে লাঞ্চ সারি এবং জাপানের সর্বশ্রদ্ধেয় সম্রাটের প্রাসাদ এলাকায় যাই এবং বাহির থেকে যতটুকু সম্ভব প্রাসাদ পর্যবেক্ষণ করি। প্রাসাদ এলাকা থেকে সরাসরি চলে যাই এয়ারপোর্টে। এদিক বিমানবন্দর পর্যন্ত পুরো সময় আমাদের সাথে ছিলেন জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম ও মি. সাসাকী। বিমানবন্দরে এসে জানতে পারি আমাদের নির্ধারিত ফ্লাইটটি বাতিল হয়ে গেছে। পরে অন্য ফ্লাইটে করে আমরা সাংহাই গিয়েছিলাম। সেই সময়টায় মি. সাসাকী আমাদের খুব সাহায্য করেছেন। রাশিদুলের আন্তরিকতাও মনে রাখার মত। ৩ দিনের জাপান সফরের স্মৃতি সারা জীবন মনে থাকবে।

২১ জানুয়ারি ১৬:৫৫ টায় আমরা হো চি মিন-এর দেশ ভিয়েতনামের উদ্দেশ্যে জাপান ত্যাগ করলাম এবং সাংহাই হয়ে স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে হ্যানয় বিমানবন্দরে পৌঁছি। বিমানবন্দরে ভিয়েতনামে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব জনাব জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত থেকে আমাদের রিসিভ করেন এবং আমাদেরকে শহরের Thang Long Opera Hotel-এ নিয়ে যান। পরদিন ২২ জানুয়ারি আমরা ‘ভিয়েতনাম ন্যাশনাল সেরিকালচার কাউন্সিল’ পরিদর্শন করি এবং সেখানকার মুখ্য কর্মকর্তা মি. Pham Van Ket-এর সাথে ভিয়েতনামের রেশম শিল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় জানতে পারি বর্তমানে ভিয়েতনামে সিল্ক-এর চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু উৎপাদন নিম্নমুখী। উক্ত অফিস পরিদর্শন শেষে আমরা একটি সিল্ক মার্কেটে যাই এবং সবাই কিছু কিছু দ্রব্যাদি ক্রয় করি। দুপুরে আমাদের হোটেলের পাশেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট লাঞ্চ সারি। সেখান থেকে একটা মিউজিয়ামে যাই যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়াদি সংরক্ষিত আছে। পুরো মিউজিয়ামটি ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখা শেষে চলে যাই হ্যানয়ের বিখ্যাত একটি শপিং মলে (নামটি ঠিক মনে পড়ছে না)। সেখানে টুকটাক জিনিসপত্র ক্রয় করে গেলাম বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব জনাব জাহিদুল ইসলাম-এর বাসায় ডিনার করতে। আলু ভর্তা থেকে শুরু করে ও যে কত রকমের আইটেম দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলো তা সঠিক মনে করতে পারছি না। অনুমান করি ১৩/১৪ রকমের তো হবেই। সবচেয়ে বড় কথা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে তার স্ত্রী যে যত্ন করে আমাদেরকে রান্না করে খাইয়েছেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা এবং মেয়ে দুটোর প্রতি রইলো স্নেহ ও আদর। জাহিদুল-এর আন্তরিকতা ছিল অকৃত্রিম। রিসিভ করা থেকে বিদায় দেয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই ও আমাদেরকে গাইড করেছে। ওর বাসা থেকে ডিনার করে হোটেলে ফিরে এসে দেখি ভিয়েতনামে বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব সুপ্রদীপ চাকমা আমাদের মাননীয় সচিব এবং টিমের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি বিদায় নিয়ে চলে যান।

পরদিন ২৩ জানুয়ারি আমরা হোটেল ত্যাগ করি এবং Commemorative Centre-এ যাই যেখানে ভিয়েতনামের প্রয়াত মহান নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক বিপ্লবী হো চি মিন-এর মরদেহ শায়িত আছে। আমাদের টিমের পক্ষ থেকে সচিব মহোদয় সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিপ্লবী হো চি মিন-এর মৃতদেহ সামনাসামনি দেখে নিজেকে অনেকটা উজ্জীবিত মনে হচ্ছিল এবং তার প্রতি ভিয়েতনামবাসীর গভীর এবং অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখে ভিয়েতনামবাসীর সংগ্রামী চেতনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। মরদেহ দেখার পর হো চি মিন-এর কুঁড়েঘরের মতো বাসভবন দেখে অবাক হলাম। অতি সাধারণ মানের ঘর এবং আসবাবপত্র। 

আমাদের দেশের অতি দরিদ্র লোকেরা যেভাবে জীবন যাপন করে তিনিও তাই করতেন। তার আগে একটি প্রশাসনিক ভবন দেখলাম। যেখানে ফরাসীরা তাদের প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন করতো। এ জায়গা দেখার পর শহরটা একটু ঘুরলাম। ১০০০ (এক হাজার) বছরের পুরনো একটি Temple of Literature দূর থেকে দেখলাম। তারপর চলে গেলাম এয়ারপোর্টে। ১৪:১০ মিনিটে আমরা ভিয়েতনাম ত্যাগ করি এবং কুয়ালালামপুর হয়ে স্থানীয় সময় ২৩:৩০ টার দিকে ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরের হোটেল Capitol-এ পৌঁছি।

২৪ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত আমরা কর্ণাটকের রামানগরম জেলায় রেশম কার্যক্রম এলাকা পরিদর্শন করি। আমরা সেখানে একটা বিরাট Cocoon market, Chawki, rearing center, extension area সহ স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলি। আমাদের সাথে ছিলেন কর্ণাটক রেশম বিভাগের উপ-পরিচালক জনাব ক. Ravindranatha। তিনি জানান যে কর্ণাটকের রামানগরম শহরকে বলা হয় Silk City এবং ভারতের রেশম চাষের বেশির ভাগটাই এ জেলায় হয়ে থাকে। কর্ণাটকে সিল্ক উৎপাদন হয় প্রায় ৭৩৬০ মেঃ টন। 

দুপুরে রেশম বিভাগের একজন কর্মকর্তা তার বাসায় আমাদেরকে আপ্যায়িত করেন যা ছিল আন্তরিকতায় ভরপুর। বেলা ৩:৩০টায় কর্ণাটক রাজ্য রেশম গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করা হয় এবং সেখানকার যুগ্ম পরিচালক মি. ই. Boraiah এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে রেশম শিল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনা থেকে জানা যায় রেশম তন্তু উৎপাদনে ভারতে পাঁচ রকমের সিল্কওয়ার্ম লালন করা হয়। এগুলো হলো Bombyx Mori(সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটি), Antherea assama, Antherea mylitta, Antherea royeli এবং Antherea Permy। আমাদেরকে সেগুলো ল্যাবরেটরিতে দেখানো হয়। এরপর আমরা হোটেলে ফিরে আসি। তারপর রাতে শহরের এক বাঙালি হোটেলে ডিনার করি যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

পরদিন ২৫ জানুয়ারি সকাল ১০:০০টায় আমরা রেশম অধিদপ্তরের কমিশনার ড. এন নাগামবিকা দেবীর কার্যালয়ে তার সাথে ভারতের রেশম শিল্পের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করি। উল্লেখ্য, ড. দেবী একজন আইএএস অফিসার। তিনি আমাদের কাছে ভারতের সর্বশেষ রেশম শিল্পের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত দিক তুলে ধরেন। বর্তমানে ভারতে স্বল্প বিনিয়োগে রেশম শিল্প থেকে কিভাবে বিনিয়োগকারীরা অধিকতর লাভবান হচ্ছে তারও ব্যাখ্যা দেন। এ খাত থেকে ইদানীং ভালো পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে বলে তিনি জানান। গত অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৮৭১.৯৯ কোটি ভারতীয় রুপী। দুপুরে আমরা লাঞ্চ করি ব্যাঙ্গালোর শহরের হোটেল ‘Empire’-এ।

সেদিন বিকেলে আমরা যাই ব্যাঙ্গালোর শহরের বিখ্যাত লালবাগ ফ্লাওয়ার পার্কে, যেখানে হাজারো রকমের ফুল দেখতে পাওয়া গেছে। সেখানে পুরো ফুল দিয়ে একটি মন্দির দেখতে পেলাম যা ছিল চমৎকার। তারপর আমরা গেলাম ‘National Mysore Reshom Emporium’-এ। সেখান থেকে আমরা কিছু কাপড়চোপড় কিনলাম। আমার মা এবং স্ত্রীর জন্য দুটো রেশমী কাপড় কিনলাম। রাতে আবার হোটেল ‘Empire’-এ খাওয়াদাওয়া করি।

পরদিন ২৬ জানুয়ারি ৬:২০ মিনিটে আমাদের প্রতিনিধি দল ব্যাঙ্গালোর ত্যাগ করে এবং কলকাতা হয়ে স্থানীয় সময় ১৪:৩৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছি।

৪ দেশে ১৩ দিনের ঐ ঝটিকা সফর স্বপ্নের মতো মনে হলেও স্মৃতিপটে জমে আছে অনেক কিছু যা আমাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে। রেশম শিল্প সম্পর্কে জেনেছি অনেক, যা আমাদের দেশের রেশম শিল্পোন্নয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

পশ্চিমবংগে নতুন বাজেটে অনিশ্চয়তায় বস্ত্র ও রেশম শিল্প

পশ্চিমবংগে নতুন বাজেটে অনিশ্চয়তায়  বস্ত্র ও রেশম শিল্প


কেন্দ্রীয় বাজেট প্রস্তাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন বস্ত্রশিল্প ও রেশম চাষের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য বস্ত্রশিল্প শ্রমিক এবং রেশম চাষী বিপন্ন বোধ করছেন। এই নতুন বাজেট প্রস্তাবের প্রভাবে অনেক মানুষ তাদের কাজ হারাতে পারেন। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ব্র্যান্ডের পোশাক এবং বস্ত্রশিল্পে উৎপাদিত পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ আবশ্যিক লেভির প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে অনেকগুলি বড় ক্ষেত্র ছাড়াও ছোট পোশাক শিল্পগুলি এই করের আওতায় চলে আসবে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ প্রান্তিক ও গরিব শ্রমিক। এই শিল্প সাধারণভাবে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোট এবং কুটির শিল্প। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে এই বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য রয়েছে। সুতো এবং ফাইবারের দাম বাড়ার ফলে এই পোশাক শিল্প এখনই বেশ সঙ্কটের মধ্যে চলছে। তার ওপর এই বাধ্যতামূলক কর চাপানো হলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের বস্ত্রশিল্পের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাড়তি কর চাপানোর সময় বস্ত্রশিল্পের এই গরিব শ্রমিকদের কথা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই বাজেটের রূপকার ইউ পি এ সরকারের শরিক মা মাটি মানুষের দল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু বাজেট তৈরির সময় বা তার পরে বস্ত্রশিল্প শ্রমিকদের এই সমস্যার বিষয়টি একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি নিয়ে প্রণব মুখার্জি ও মমতা ব্যানার্জির মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। কিন্তু সেই আলোচনায় অনুপস্থিত পোশাক শিল্প ও রেশম চাষ। গরিব শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নন রেলমন্ত্রী। কৃষকদের স্বার্থের বিষয়ে সব সময়ই নাকি উদ্বিগ্ন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবের ফলে এরাজ্যের রেশম চাষীরা যে বিপদে পড়তে পারেন সে সম্পর্কে মাথা ঘামাতে চান না তৃণমূল নেত্রী। বাজেটে ‘র’-সিল্কের ওপর বহির্শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই শুল্ক কমানোর প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের স্বার্থ রক্ষা হবে। কিন্তু এই নতুন প্রস্তাব রেশম চাষে যুক্ত মানুষদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করতে পারে। ‘র’-সিল্কের বহির্শুল্ক কমানোর প্রস্তাবে ভারতের বাজারে বিদেশের সস্তা সিল্ক ছেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে রেশম চাষে যুক্ত অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংসের সামনে দাঁড়াবে। এই প্রশ্নেও সম্পূর্ণ নীরব তৃণমূল নেত্রী। কৃষক দরদী মমতা ব্যানার্জিও রেশম চাষীর স্বার্থবিরোধী এই বাজেট প্রস্তাবের শরিক। পশ্চিমবঙ্গে বস্ত্র শিল্পের শ্রমিক ও রেশম চাষের সঙ্গে যুক্ত মানুষের স্বার্থে এই দুটি বাজেট প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

কংগ্রেস তার জনবিরোধী আর্থিক নীতি রূপায়ণ করার কাজে প্রকৃত শরিক পেয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সহযোগিতা নিয়েই কংগ্রেস তার জোট সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত বড়লোকদের স্বার্থে নীতিকে অব্যাহত রেখেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে রেখেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দ্বিতীয় ইউ পি এ জোট সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যেও রয়েছে তৃণমূল। এই সরকারের আমলে মূল্যবৃদ্ধির কোনো প্রতিকার নেই। বেড়ে চলেছে পেট্রোপণ্যের দাম। এই সরকারের আমলেই দুর্নীতি ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই সমস্ত নীতি ও কাজের শরিক তৃণমূল। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার জন্য তৃণমূল যে-কোনো প্রস্তাবই মেনে নিতে রাজি। বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক ও রেশম চাষের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের স্বার্থবিরোধী কাজেও তাই নিরুত্তর তৃণমূল নেত্রী। এইসব ঘটনা থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বুঝে নিতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকৃত পরিচয়।

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শীঘ্রই দেশ রেশম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে



দৈনিক জনকন্ঠ
রবিবার, ৮ মে ২০১১, ২৫ বৈশাখ ১৪১


শীঘ্রই দেশ রেশম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে
বিজনেস ডেস্ক ॥ তিন থেকে চার বছরের মধ্যে রেশম শিল্পে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য সরকার ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিতে যাচ্ছে। সম্প্রতি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতি এবং সিল্ক ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় রেশম শিল্পকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে কয়েকটি গুরম্নত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে- কৃষি শিল্পে প্রদেয় সকল সরকারি সুবিধা রেশম শিল্পকে প্রদান করা, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ২৫টি তুঁত গাছ লাগানো এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে রেশম সুতা তৈরিতে সহায়তা প্রদান করা, যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে রেশমকে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং বেসরকারি খাতে রেশম পলস্নী স্থাপনে সহায়তা প্রদান করা। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বছরে ৩০০ মে.টন রেশম সুতার চাহিদা রয়েছে।
সভায় অন্যদের মধ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আশরাফুল মকবুল, বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফৌজদার মোঃ শফিকুল ইসলাম, সিল্ক ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট আলাউদ্দিন আহমেদ এবং বিশিষ্ট রেশম ব্যবসায়ী সদর আলী উপস্থিত ছিলেন।