শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রেশমের কথা

রেশমের কথা 


নব্য প্রস্তর যুগের পরবর্তী সময়ে মানুষ চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করার পর থেকে সভ্যতার স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটে। লৌহ ও তাম্র যুগে অস্ত্র নির্মাণ, বাসন-কোসন, বস্ত্র ইত্যাদি প্রস্তুতে মনোযোগী হয়, মানুষ নিজেকে নানাভাবে সৌন্দর্য চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৌন্দর্য বিকাশে মনোযোগী হয়। সৌন্দর্য বিকাশের সাধনায় নানা আবিষ্কার যেমন বাড়িঘর নির্মাণ, ব্যবহারিক বাসন-কোসন, পরিধেয় বস্ত্র, খাবারের নানা উপকরণ, যানবাহন ইত্যাদি, তেমনি ১৯২৯ সালের পর পেইচিং (বেইজিং) শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে চৌখতিয়ান নামক স্থানে মকর মানব নামে এক জাতি বাস করতো সময়কাল ছিল ভূগঠনের চতুর্থ যুগে। যারা ‘পিকিং মানব’ বা পেইচিং মানব নামে পরিচিত ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে পীত নদীর অববাহিকায় পীত সভ্যতা নামে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। পীত সভ্যতা বলতে আধুনিক হোয়াংহু নদীর অববাহিকাকে বোঝায়, যা বেইজিং শহরের কাছাকাছি। এক সময়ে হোয়াংহুকে চীনের দুঃখ বলা হতো। পীত সভ্যতা বলতে চীন সভ্যতা বোঝায়। 
প্রাগৈতিহাসিক যুগের চীনের প্রাচীন গ্রন্থে নানা প্রকার উপাখ্যানের উল্লেখ আছে, এমনি একটি উপাখ্যানে ‘হুয়াংতি’ নামে এক সম্রাট ছিলেন। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী সম্রাট ছিলেন। তদানীন্তন নানা উপজাতিদের নিজের অধীনস্থ করেছিলেন। তার স্ত্রী ‘সম্রাজ্ঞী লেইজু’ সর্বপ্রথম রেশমগুটি থেকে সুতা তৈরি ও রেশম গুটিপোকার চাষ প্রবর্তন করেন। রেশমের আবিষ্কার প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে অতীত ইতিহাসের অংশটুকু প্রাসঙ্গিকভাবে এসে যায়। ইতিহাসে ‘চৌ ডাইনেস্টি’ (১১২২ থেকে ২৫৫) খ্রিস্টপূর্ব চীনাদের স্বর্ণযুগ বলা যায়। চৌ ডাইনেস্টির আমলে পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াস, লাওতেজ ও সুন্দর সিল্কের জন্ম ঘটে। চৌ ডাইনেস্টির পর ‘হান’ ডাইনেস্টির আমলে (২০৬ খ্রিস্টপূর্ব ২১৪ খ্রিস্টাব্দে) মধ্য এশিয়া ও পারস্য ছাড়া চীনাদের তৈরি সিল্ক ও অন্যান্য সামগ্রী বাণিজ্যিক কারণে ইউরোপে (কেরাভেন) উটের সাহায্যে নেয়া হতো। উটের মাধ্যমে বাণিজ্যিক যাতায়াতের পথকে সিল্ক রোড হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তাছাড়া ভারত, সৌদি আরব, গ্রিস ও রোম সিল্কের জন্য একই পথ ব্যবহার করত। চীনারা সিল্কের বিনিময়ে মূল্যবান পাথর, আইভরি (হাতির দাঁত) খোদাইয়ের জন্য এবং ঘোড়া আমদানি করত।
সিল্ক রোড উদ্বোধনের আগে চীনাদের সংস্কৃতি আপন গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। সিল্ক রোডের ফসল হিসেবে চীনা সংস্কৃতি বিনিময়ের খোলা জানালা উন্মোচিত হয় যা পরবর্তী সময়ে চীনা সংস্কৃতির বিরাট পরিবর্তন ঘটায়। পরিবর্তনটি চীনাদের পোশাকে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ৭০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে তুর্কী ও মোগলদের আগমনের ফলে প্রাচীন চীনাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের পরিবর্তে ‘কাফতান’ সরু হাতওয়ালা লম্বা কোট ব্যবহার শুরু করে। মুসলমানদের আবির্ভাবের আগে থেকে আরব বণিকেরা চীনের সঙ্গে সিল্কের ব্যবসা শুরু করে, বিনিময়ে সুগন্ধি আতর চীনাদের কাছে বিক্রি করে। আরবদের হেরেমে সিল্ক অত্যন্ত প্রিয় ছিল, কারণ ঝলসানো রংয়ে চীনাদের সিল্ক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
চীনাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হলেও সিল্কের ক্ষেত্রে কোনো যান্ত্রিকতার ব্যবহার করেনি। সম্পূর্ণ হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে সিল্ক বস্ত্র তৈরি করা হতো। তারা সিল্ক তৈরি ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় তাঁতে সিল্ক তৈরি করত। এমনকি চীনারা সিল্কের এই গুরু রহস্য কাউকে জানতেও দিত না। যদি কেউ সিল্ক তৈরি পদ্ধতি প্রকাশ করত, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো।
আরব বণিকেরা সিল্কের গুরু রহস্য চীনাদের কাছ থেকে জেনে দক্ষিণ তিউনেশিয়ায় গুটিপোকার চাষাবাদ শুরু করে।
চীনারা প্রাথমিক যুগে তন্তু দ্বারা তৈরি কাপড়, চামড়া বা সুতি কাপড় ব্যবহার করতো শীতকালে ঠাণ্ডা থেকে আত্মরক্ষার জন্য, মোটা কাপড় অথবা চামড়া দ্বারা তৈরি জ্যাকেটের মাধ্যমে। সিল্কের উদ্ভাবনের পর চীনা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের পারিবারিক পোশাকে উজ্জ্বল রংয়ের সিল্কের কাপড় ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া সিল্কের নকশি করা দড়ির মাধ্যমে তাদের অবস্থান ও মর্যাদা নির্ধারণ করা হতো।
একই সময়ে মঙ্গোলিয়া, তুরস্ক, তিব্বত ও মধ্য এশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উত্সবের পোশাক হিসেবে গৃহীত হতো সিল্ক। চাইনিজ সিল্ক আরবদের কাছেও একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাকে পরিণত হয়। ধনী আরবদের কাছে সিল্ক সম্মানজনক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সিল্কের সঙ্গে হীরা-জহরতের ঔজ্জ্বল্যের সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয় যা আরবদের অত্যন্ত পছন্দ। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মীয় আচারে সিল্ক ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। 
কথিত আছে, একটি সূক্ষ্ম বুননের মূল্যবান সিল্ক বস্ত্রখণ্ড রক্ষিত আছে, যা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো, যা কেবল রাজকুমারীর দেখার অধিকার আছে। কোনো বিদেশি রাজকুমারীর চীনে আগমন ঘটলে তাদের রেশম গুটিপোকা উপহার হিসেবে দেয়া হতো। বিভিন্ন লিখিত তথ্যে জানা যায়, আরবরাই এক সময়ে পৃথিবীতে সিল্কের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত। তাছাড়া আরবদের পোশাকের ক্ষেত্রে চীনের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; চীনারা আরবদের জন্য সিল্ক মজুত করে রাখত। সিল্ক ছাড়া মূল্যবান হীরক ঝলসানো নানারকম দামি পাথর ও মসলা এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে যেত।
২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারসিকদের ভারত বিজয়ের পর হিন্দুস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত প্রতিবেশী ইরানের অঙ্গীভূত হয়। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার কর্তৃক ভারত আক্রান্ত হয়। সিন্ধু সভ্যতা আলেকজান্ডারের নিয়ন্ত্রণে আসে। ভূমধ্যসাগর আশপাশের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার ফলে ভারতের সঙ্গে মসলিন, সিল্ক চাদর, খোদাইকৃত হাতির দাঁতের তৈজসপত্র, মূল্যবান পাথর চীন, ব্যাবিলন ও গ্রিসের সঙ্গে বিনিময় ব্যবসা স্থাপিত হয়। ভারতের বিশেষ করে কাশ্মীর অঞ্চল সিল্ক ও পশমি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাছাড়া ভারতের হায়দরাবাদ, লক্ষ্মৌ, পাঞ্জাব, বেনারস ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সিল্কের জন্য খ্যাত। গত পাঁচ হাজার বছর ধরে এই সিল্ক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হয়ে আসছে। 
চীন ও ভারত ছাড়া থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ বর্তমানে সিল্কের জন্য খ্যাত।
ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীর পরে সিল্ক রোডের মাধ্যমে, যা মধ্য চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। এই দুর্গম সিল্ক রোডটি হান ডাইনেস্টির আমলে ‘জাং কুইয়া’ নামক পূর্ব চীনের ব্যবসায়ী আবিষ্কার করেন। তার কিছুকাল পর জিন ডাইনেস্টির আমলে ফান হিয়েন। তুং ডাইনেস্টির আমলে ‘জিয়ান জং’ এবং ইতালীয় পর্যটক মার্কো পলো ভারত এসেছিলেন। তাছাড়া ‘ফাহিয়ান’ ‘জেকবদি এনকোলা’ একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী, মার্কো পলো এবং মরক্কো রাজ্যের পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই নৌপথটিও সিল্ক জলরোড হিসেবে পরিচিত। চীনের মিং ডাইনেস্টির আমলে সপ্তম নৌবহরের কমান্ডার বাংলাদেশে দু’বার ভ্রমণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের এই পথটি দক্ষিণ অঞ্চলের তৃতীয় সিল্ক রোড নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সঙ্গে এই সিল্ক রোডটি স্থাপিত হয় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের সম্পর্ক প্রায় ২৪০০ বছরের। হান ডাইনেস্টির বিখ্যাত ঐতিহাসিকের লেখার মাধ্যমে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম সিল্ক রোড দক্ষিণ সিল্ক রোডের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এর যোগাযোগ ছিল। ব্যাকটেরিয়া বর্তমানের আফগানিস্তান। উত্তর হিন্দুকুশ পর্বতমালার পাদদেশ দিয়ে এই পথটি মধ্য এশিয়া ও ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জিং কোফং নামক এই ঐতিহাসিক উত্তর হিন্দুকুশ পর্বতমালার এ পথ ধরে মধ্য এশিয়া ভ্রমণ শেষে ব্যাকটেরিয়ায় ফেরত আসেন। চীন থেকে এর দূরত্ব ছিল প্রায় ৬ হাজার মাইল। বাংলাদেশের সোনারগাঁ, ঢাকা অঞ্চলের বিখ্যাত মসলিন এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপ হয়ে পারস্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। ফলে বাংলাদেশেও শিল্প উত্পাদন প্রায় কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশে সিল্কের উত্পাদন এখন কিছুটা কমে গেলেও অতীতে সিল্ক, মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি শাড়ি ও কাপড় ঢাকার আশপাশে তৈরি হতো। পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন কাপড়ও এখানে তৈরি হতো, যা এখন আর তৈরি হচ্ছে না। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিল্ক ও গুটিপোকার চাষ প্রচলিত ছিল। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চল ছাড়া তেমন কোনো অঞ্চলে রেশম বা সিল্কের চাষ দেখা যায় না। ১৯৫৬ সালের দিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ অঞ্চলে অত্যন্ত উন্নতমানের সিল্ক সুতা ও সিল্ক কাপড় উত্পন্ন হতো। সেখানে গুটিপোকার বিরাট খামার ছিল। বাংলাদেশের রাজশাহী ছাড়া বগুড়া, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে সিল্ক উত্পন্ন হতো। বাংলাদেশে সাধারণত হ্যান্ডলুমের মাধ্যমে সিল্ক উত্পাদিত হয়ে আসছে।
থাইল্যান্ড, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার হলে বাংলাদেশ সিল্ক উত্পাদনে বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান করে নিতে পারত।
মসলিন, জামদানি, টাঙ্গাইল ও ঢাকাই শাড়ির মতো মধ্যযুগে পৃথিবীব্যাপী যে সুনাম আমরা অর্জন করেছিলাম তা অক্ষুণ্ন থাকত। আসুন আমরা সবাই মিলে হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন