আমার দেখা ৪টি দেশ আর কিছু অভিজ্ঞতা
ড. অর্ধেন্দু শেখর রায় (পি এস , বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী)
১৩ দিনে কানেক্টিং ফ্লাইটসহ ১২ বার বিমানে ওঠানামা অনেকটা অবিশ্বাস্যই মনে হয়, তাই না! কিন্তু বাস্তবে এমনই একটি ভ্রমণ করতে হয়েছে গত ১৪ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব জনাব আশরাফুল মকবুলের নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি টিম রেশম শিল্পের উন্নয়ন এবং এর সর্বশেষ অবস্থা সরেজমিনে দেখা ও জানার জন্য চীন, জাপান, ভিয়েতনাম এবং ভারতের ব্যাঙ্গালোর সফর করা হয়।
টিমের অন্য সদস্যরা হলেন:
(১) সুনিল চন্দ্র পাল, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড
(২) মোঃ ইমদাদুল হক, যুগ্ন-সচিব, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
(৩) মোঃ সাইফুল আলম হামিদী, যুগ্ম-প্রধান, পরিকল্পনা কমিশন
(৪) মোঃ মনছুরুল আলম, উপ-প্রধান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়
(৫) মোঃ আব্দুল হামিদ মিয়া, পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট
(৬) মোঃ আমজাদ হোসেন, পরিচালক, আইএমইডি
(৭) শেখ আখতার হোসেন, পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
(৮) মোঃ মোরতোজা রেজা, চীফ প্লানিং, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড
(৯) আলাউদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, সিল্ক ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন।
উক্ত টিমের ১ জন সদস্য হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। মাননীয় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আমাকে এ ধরনের একটি সুযোগ করে দেয়ার জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ৪ দেশের এই সফরে দু’একটি ঘটনা বাদে পুরোটাই ছিল আনন্দদায়ক, সুখকর, মজার এবং সর্বোপরি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ। চীনে মাইনাস টোয়েন্টি এবং জাপানে মাইনাস টেন পর্যন্ত তাপমাত্রায় আমরা অবস্থান করেছি। ভিয়েতনাম এবং ভারতে মোটামোটি সহনীয় তাপমাত্রা ছিল।
১৪ জানুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিমান ছাড়ে। তারপর চীনের কুনমিং হয়ে স্থানীয় সময় রাত ১২টার দিকে বেইজিং বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের বেইজিং শহরের কেন্দ্রস্থলে সিটি হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলে আনুষঙ্গিক কার্যাদি সম্পন্ন করে রাত ২টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন ১৫ জানুয়ারি সকালে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের ১টি, চীনের প্রাচীর দেখার জন্য আমরা রওনা হই। তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস টোয়েন্টি। প্রাচীরের পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিষয়টি অতটা বুঝে উঠতে পারিনি। বাতাস বইছিল তীব্র বেগে। প্রাচীরে ওঠার ৫/১০ মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং বাতাসের বেগে আমরা কেউ-ই আর হাঁটতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল প্রচন্ড ঠাণ্ডায় আমরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আমাদের মধ্য থেকে কে যেন বলছিল “স্যার, চলেন নেমে পড়ি”। প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে নেমে পড়লাম এবং নিচে আরও প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পর একটা রেস্তোরাঁয় আশ্রয় নিলাম। রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর মনে হচ্ছিল এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে লক্ষ্য করলাম সবাই আমার মতো রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেছে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে স্যুপ খেয়ে আবার বেইজিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রাচীর দর্শনের সেই স্মৃতি সারাজীবন মনে থাকবে। বিকেলে সবাই মিলে একটা ছোট্ট মার্কেটে গেলাম। কিছুক্ষণ টুকটাক শপিং করে ফেরার পথে দূর থেকে তিয়েন মেন স্কোয়ার দেখি এবং আমাদের সাথে যিনি গাইড ছিলেন তিনি দূর থেকে মাও সেতুং-এর মরদেহ যে ভবনে সংরক্ষিত আছে সে ভবনটি দেখান। তারপর গাইডের সহায়তায় একটা বাঙালি হোটেলে সন্ধ্যায় তৃপ্তিসহকারে খাবার খেয়ে পুনরায় আরও একটি সিল্ক মার্কেটে যাই এবং ঘণ্টা দুয়েক ছোট খাটো শপিং শেষ করে হোটেলে ফিরলাম।
পরদিন ১৬ জানুয়ারি আমাদের টিম চংকিংয়ের উদ্দেশ্যে বেইজিং ত্যাগ করে। সাংহাই হয়ে কানেক্টিং ফ্লাইটে চংকিং পৌঁছি সন্ধ্যার দিকে। চংকিং শহরের কেন্দ্রে YUDU হোটেলের ২৬ তলার বিভিন্ন কক্ষে আমরা অবস্থান করি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমাদের ১১ জনের টিমে ১ জন বাদে (জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ) বাকী ১০ জনের জন্যই ছিল এটা প্রথম চীন সফর। প্রথমদিন যখন বেইজিং শহর দেখলাম তখন এর চোখ ধাঁধানো উন্নতি দেখে আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। যেদিকে তাকাই আধুনিক এবং পরিকল্পিত সু-উচ্চ ইমারত। শহরের যতটুকু অংশ ঘুরেছি তাকিয়ে শুধু বিমোহিত হয়েছি। তখন মনে মনে ধারণা করেছি বেইজিং শহরের সাম্প্রতিক এতটা উন্নতির কারণ হয়তো বা গত বেইজিং অলিম্পিক। কিন্তু সে ধারণা ভাঙলো চংকিং শহরে গিয়ে। বিখ্যাত ইয়াংসি নদীর তীরের এই শহরটিকে ‘মিনি হংকং’ বলা হয়ে থাকে। সেই শহরের একজন মহিলা Mrs. খবর (যিনি আমাদের টিমের সদস্য জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ-এর পূর্ব পরিচিত) ১৭ জানুয়ারি রাতের বেলায় আমাদের কয়েকজনকে শহরটি ঘুরিয়ে দেখান। আমি, আলাউদ্দিন ভাই, মনসুর এবং সেই মহিলা রাতে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শহরটিকে প্রত্যক্ষ করলাম। কী সুন্দর যে লাগছিলো বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। শুধু নদীর পাড়ই নয় শহরের যতটুকু অংশ দেখেছি তাতে মনে হয়েছিল এটি বেইজিং-এর চেয়েও উন্নত। তার মানে শুধু বেইজিং নয় পুরো চীনেরই অভুতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। তার আগে সকালে আমাদের টিম-এর একাংশ মাননীয় সচিব-এর নেতৃত্বে ‘চায়না সিল্ক মেটেরিয়ালস’ এবং ‘ফেব্রিক্স ইমপোর্ট এক্সপোর্ট কর্পোরেশন’ পরিদর্শন করেন এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেন। বিকেলে একটি সিল্ক রিলিং ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করা হয়। উক্ত ফ্যাক্টরির মালিক জনাব ঝং চেং-এর কাছ থেকে চীনে রেশম-এর আবিষ্কার এবং এর ব্যবহারের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। বিশ্বে রেশম উৎপাদনে চীনের স্থান হচ্ছে সবার উপরে। প্রায় ৩৬,০০০ মেট্রিক টন। রপ্তানিতেও দেশটি সবার উপরে।
১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে আমরা হোটেল ত্যাগ করি জাপানের উদ্দেশ্যে। আবার সাংহাই হয়ে স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটায় টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমানবন্দরে আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন টোকিওতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম এবং আমাদের টিম মেম্বার জনাব মোঃ মনসুরুল আলম-এর ভাগ্নে জনাব মোঃ সানাউল হক। চার দেশের সফরে চার রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এর মধ্যে জাপানের অভিজ্ঞতা ছিল মধুর এবং প্রাণবন্ত। অনেকের সংস্পর্শেই এসেছি। তারপরও জনাব সানাউল-এর সান্নিধ্য ছিল স্মরণীয়। তিন দিনের জাপান সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আমাদের একান্ত সহচর। যাইহোক, এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রোতে করে টোকিওতে এসে Mystay Ochanomizu হোটেলে মালামাল রেখে সানাউল আমাদেরকে একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন এবং ডিনার করালেন। তারই সহযোগিতায় পরদিন অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি বুলেট ট্রেনে করে হিরোশিমার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। টোকিও স্টেশন থেকে নজুমা সুপার এক্সপ্রেসে (বুলেট ট্রেনের নাম) চড়লাম। সকাল ৭:১০ মিনিটে ট্রেন যাত্রা শুরু করলো ২৭০ কিঃ মিঃ বেগে। টোকিও থেকে হিরোশিমার দূরত্ব ৮৯৪ কিঃ মিঃ। মাঝপথে ৬/৭টি স্টেশনে বিরতি ছিল। আমরা ঠিক ১১:১০ মিনিটে হিরোশিমা স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখানে আমাদেরকে রিসিভ করলেন কক্সবাজারের মেয়ে এ্যানি। সত্যি, কি মধুর স্মৃতি! মেয়েটি সানাউলের পরিচিত। পুরোটা সময় তিনি যেভাবে আমাদের সঙ্গ দিলেন তাতে মনে হচ্ছিলো আমরা তার পরিবারেরই সদস্য। কি আন্তরিকতা! মেয়েটির স্বামী হিরোশিমায় চাকরি করে এবং মেয়েটি সেখানে পিএইচডি করছে বলে জানা যায়। যে উদ্দেশ্যে হিরোশিমায় যাওয়া সেই বোমা বর্ষণের স্থানে এ্যানি আমাদের নিয়ে গেলেন।
জানা যায়, বোমাবর্ষণকালে হিরোশিমার উল্লেখযোগ্য শিল্প ও সামরিক গুরুত্ব ছিল। হিরোশিমার কাছাকাছি কয়েকটি সামরিক স্থাপনা ছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পঞ্চম ডিভিশনের সদর দপ্তর এবং ফিল্ড মার্শাল জাতার নেতৃত্বাধীন সেকেন্ড জেনারেল আর্মি হেড হেডকোয়ার্টার্স, যা পুরো দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপানের প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতো। হিরোশিমা ছিল জাপানি সামরিক বাহিনীর একটি প্রধান সরবরাহ ও লজিস্টিক ঘাঁটি। শহরটি ছিল একটি যোগাযোগ ও মজুত কেন্দ্র এবং সৈন্যদের সমবেত হওয়ার স্থান। জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী এই বোমা নিক্ষেপ করে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮:১৫ মিনিটে মানবজাতির বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রথম এ্যাটম বোমাটি বিস্ফোরিত হয় জাপানের এই স্থানে। তাৎক্ষণিক নিহত হয় ১ লাখ ২০ হাজার লোক এবং পরে প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ। বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। বিমানের চালক কর্নেল পল টিবেটস-এর মায়ের নামে বি-২৯ বিমানটির নামকরণ করা হয় ‘এনোলা গে’ যার নম্বর ছিল ৪৪-৮৬২৯২ এবং বোমাটির নাম ছিল ‘লিটল বয়’। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ফুট উঁচুতে ১৩ কিলোটিন শক্তিতে ‘লিটল বয়’ বিস্ফোরিত হয়।
হিরোশিমায় আনবিক বোমাবর্ষণ কত ভয়ংকর ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আনবিক বোমা নিক্ষেপের ১৬ ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস এই ঘটনা সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়। বিস্ফোরণের পর যারা জীবিত ছিলেন তাদের আনুমানিক ১ শতাংশ মানুষ বিস্ফোরণ পরবর্তী তেজষ্ক্রিয়তায় মারা যায়। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত হিরোশিমায় আনবিক বোমাবর্ষণে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬২ জন। তবে তাদের মধ্যে বোমার প্রতিক্রিয়ায় কতজন মারা গেছে তা ছিল অস্পষ্ট। ২০০৪ সালের শেষ নাগাদ জাপানে বোমায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার।
বোমাবর্ষণস্থানে আমাদের টিমের সকল সদস্য কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমরা গেলাম হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে। এর দুটি অংশ। পূর্ব এবং মূল অংশ। পূর্ব ভবনে দেখানো হয় বোমাবর্ষণের পূর্বের হিরোশিমা শহর এবং বোমাবর্ষণের পরের হিরোশিমা শহর। মূল ভবনে দেখানো হয় এ্যাটম বোমা এবং যুদ্ধ বিমানসমূহ।
হিরোশিমার পর ঘণ্টাখানের ট্রামপথ পাড়ি দিয়ে এ্যানি আমাদের নিয়ে গেলেন মিয়াজিমা আইল্যান্ডে। স্টিমারে করে আইল্যান্ড পার হলাম। বিকেল বেলা কি অপূর্ব মনোরম দৃশ্য! মনের অজান্তেই আনন্দে গান গাইতে শুরু করলাম “আমি বন্ধু প্রেমে হইলাম পাগল” আর অমনি সানাউল তার হাতের ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে গানটি বন্দী করে ফেললো। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক শেখ আখতার হোসেন। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেক থেকে আবার স্টিমারে করে এপারে চলে আসলাম এবং ট্রেনে করে হিরোশিমা হয়ে আবার টোকিও চলে আসলাম। এসে খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ২টা বেজে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন হিরোশিমা যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ফুজিকে (৩৭৭৬ মিটার) দেখা গেছে। পুরো রাস্তার দু’দিকেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। হিরোশিমার স্মৃতি কোনোদিনও ভুলবো না। এ্যানিকে অসংখ্য ধন্যবাদ পুরো সময় আমাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য।
পরদিন অর্থাৎ ২০ জানুয়ারি ৯:৩০ টায় আমরা Gurma Prefeeture-য়ে Silkworm Fiber Technology Center পরিদর্শন করি এবং পরিচালক Mr. Machida-র সাথে সচিব মহোদয় রেশম সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেন। পরে Tamioka-তে সিল্ক প্রোডাক্ট ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করি। আমাদের সাথে পুরোটা সময় ছিলেন জনাব রাশিদুল হাসান ও একজন জাপানি দো-ভাষী মি. সাসাকী।
পরিদর্শন শেষে আমরা যাই শপিং করতে বিখ্যাত একটি শপিং মলে। সেখানে টুকটাক শপিং শেষে যাই মি. সানাউলের অফিসে। সানাউল হক্ সাদিয়াটেক কোঃ লিঃ-এর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘দশদিক’-এর সম্পাদক। তিনি আমাদের সাথে তার অফিসে কর্মরত কর্মকর্তাদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার কার্যক্রম আমাদের সামনে তুলে ধরেন। আমাদেরকে বিভিন্ন ধরণের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেন এবং পরিশেষে তাঁর পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। জনাব সানাউল দুই পুত্র এবং দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর অকৃত্রিম এবং আন্তরিক ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ। আমরা সবাই তার উন্নতি কামনা করি।
সন্ধ্যায় জাপানে বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব মজিবর রহমান ভূঁইয়া আমাদের টিমকে তার বাসভবনে ডিনারে আপ্যায়িত করেন। আমাদের টিম ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় দূতাবাসের ইকনমিক মিনিস্টার জনাব এ.কে.এম মানজুরুল হক, এনডিসি, কমার্শিয়াল কাউন্সেলর জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম এবং প্রথম সচিব জনাব মোঃ নাজমুল হুদা। মান্যবর রাষ্ট্রদূত যে আন্তরিকতার সাথে আমাদের দেশীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করেছেন সেজন্য আমরা গর্বিত এবং কৃতজ্ঞ। রাতে হোটেলে আসেন আমাদের সচিব স্যারের প্রাক্তন একান্ত সচিব ড. মোকছেদ এবং টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান (নাহিদ)। মোকছেদ পূর্বপরিচিত হওয়ায় তাঁকে পেয়ে খুব ভাল লাগছিল। নাহিদ ছেলেটা খুব প্রাণবন্ত ও আন্তরিক। তাঁকে আমার খুব ভাল লেগেছে।
২১ জানুয়ারি সকাল ৯:০০টায় আমরা হোটেল ত্যাগ করি। ১০:০০টায় আমরা জাপান সিল্ক এসোসিয়েশন পরিদর্শন করি। সেখানে সচিব মহোদয় ও রেশম বোর্ডের কর্মকর্তাগণ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাগণের সাথে আলোচনা করেন। সেখানে আমরা জানতে পারি জাপানে ধীরে ধীরে তুঁত চাষের ফলন কিভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে রেশম উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সিংহভাগ তারা আমদানী করে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। পরবর্তীতে আমরা জাপান সিল্ক সেন্টারে বিভিন্ন দ্রব্যাদি পরিদর্শন করি।
তারপর ১৯৫৮ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘টোকিও টাওয়ার’ দেখতে যাই যার উচ্চতা ৩৩৮ ফুট। টাওয়ারটি দেখতে খুবই সুন্দর। অনেকটা আইফেল টাওয়ারের আদলেই তৈরি। টাওয়ার ভবনে কিছু টুকটাক সদাই করে লাঞ্চ কিনে গাড়িতে বসে লাঞ্চ সারি এবং জাপানের সর্বশ্রদ্ধেয় সম্রাটের প্রাসাদ এলাকায় যাই এবং বাহির থেকে যতটুকু সম্ভব প্রাসাদ পর্যবেক্ষণ করি। প্রাসাদ এলাকা থেকে সরাসরি চলে যাই এয়ারপোর্টে। এদিক বিমানবন্দর পর্যন্ত পুরো সময় আমাদের সাথে ছিলেন জনাব মোঃ রাশিদুল ইসলাম ও মি. সাসাকী। বিমানবন্দরে এসে জানতে পারি আমাদের নির্ধারিত ফ্লাইটটি বাতিল হয়ে গেছে। পরে অন্য ফ্লাইটে করে আমরা সাংহাই গিয়েছিলাম। সেই সময়টায় মি. সাসাকী আমাদের খুব সাহায্য করেছেন। রাশিদুলের আন্তরিকতাও মনে রাখার মত। ৩ দিনের জাপান সফরের স্মৃতি সারা জীবন মনে থাকবে।
২১ জানুয়ারি ১৬:৫৫ টায় আমরা হো চি মিন-এর দেশ ভিয়েতনামের উদ্দেশ্যে জাপান ত্যাগ করলাম এবং সাংহাই হয়ে স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে হ্যানয় বিমানবন্দরে পৌঁছি। বিমানবন্দরে ভিয়েতনামে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব জনাব জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত থেকে আমাদের রিসিভ করেন এবং আমাদেরকে শহরের Thang Long Opera Hotel-এ নিয়ে যান। পরদিন ২২ জানুয়ারি আমরা ‘ভিয়েতনাম ন্যাশনাল সেরিকালচার কাউন্সিল’ পরিদর্শন করি এবং সেখানকার মুখ্য কর্মকর্তা মি. Pham Van Ket-এর সাথে ভিয়েতনামের রেশম শিল্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় জানতে পারি বর্তমানে ভিয়েতনামে সিল্ক-এর চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু উৎপাদন নিম্নমুখী। উক্ত অফিস পরিদর্শন শেষে আমরা একটি সিল্ক মার্কেটে যাই এবং সবাই কিছু কিছু দ্রব্যাদি ক্রয় করি। দুপুরে আমাদের হোটেলের পাশেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট লাঞ্চ সারি। সেখান থেকে একটা মিউজিয়ামে যাই যেখানে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়াদি সংরক্ষিত আছে। পুরো মিউজিয়ামটি ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখা শেষে চলে যাই হ্যানয়ের বিখ্যাত একটি শপিং মলে (নামটি ঠিক মনে পড়ছে না)। সেখানে টুকটাক জিনিসপত্র ক্রয় করে গেলাম বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব জনাব জাহিদুল ইসলাম-এর বাসায় ডিনার করতে। আলু ভর্তা থেকে শুরু করে ও যে কত রকমের আইটেম দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলো তা সঠিক মনে করতে পারছি না। অনুমান করি ১৩/১৪ রকমের তো হবেই। সবচেয়ে বড় কথা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে তার স্ত্রী যে যত্ন করে আমাদেরকে রান্না করে খাইয়েছেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা এবং মেয়ে দুটোর প্রতি রইলো স্নেহ ও আদর। জাহিদুল-এর আন্তরিকতা ছিল অকৃত্রিম। রিসিভ করা থেকে বিদায় দেয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই ও আমাদেরকে গাইড করেছে। ওর বাসা থেকে ডিনার করে হোটেলে ফিরে এসে দেখি ভিয়েতনামে বাংলাদেশের মান্যবর রাষ্ট্রদূত জনাব সুপ্রদীপ চাকমা আমাদের মাননীয় সচিব এবং টিমের অন্যান্য সদস্যদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। কিছুক্ষণ কথা বলে তিনি বিদায় নিয়ে চলে যান।
পরদিন ২৩ জানুয়ারি আমরা হোটেল ত্যাগ করি এবং Commemorative Centre-এ যাই যেখানে ভিয়েতনামের প্রয়াত মহান নেতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক বিপ্লবী হো চি মিন-এর মরদেহ শায়িত আছে। আমাদের টিমের পক্ষ থেকে সচিব মহোদয় সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিপ্লবী হো চি মিন-এর মৃতদেহ সামনাসামনি দেখে নিজেকে অনেকটা উজ্জীবিত মনে হচ্ছিল এবং তার প্রতি ভিয়েতনামবাসীর গভীর এবং অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখে ভিয়েতনামবাসীর সংগ্রামী চেতনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। মরদেহ দেখার পর হো চি মিন-এর কুঁড়েঘরের মতো বাসভবন দেখে অবাক হলাম। অতি সাধারণ মানের ঘর এবং আসবাবপত্র।
আমাদের দেশের অতি দরিদ্র লোকেরা যেভাবে জীবন যাপন করে তিনিও তাই করতেন। তার আগে একটি প্রশাসনিক ভবন দেখলাম। যেখানে ফরাসীরা তাদের প্রশাসনিক কাজকর্ম সম্পাদন করতো। এ জায়গা দেখার পর শহরটা একটু ঘুরলাম। ১০০০ (এক হাজার) বছরের পুরনো একটি Temple of Literature দূর থেকে দেখলাম। তারপর চলে গেলাম এয়ারপোর্টে। ১৪:১০ মিনিটে আমরা ভিয়েতনাম ত্যাগ করি এবং কুয়ালালামপুর হয়ে স্থানীয় সময় ২৩:৩০ টার দিকে ভারতের ব্যাঙ্গালোর শহরের হোটেল Capitol-এ পৌঁছি।
২৪ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত আমরা কর্ণাটকের রামানগরম জেলায় রেশম কার্যক্রম এলাকা পরিদর্শন করি। আমরা সেখানে একটা বিরাট Cocoon market, Chawki, rearing center, extension area সহ স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলি। আমাদের সাথে ছিলেন কর্ণাটক রেশম বিভাগের উপ-পরিচালক জনাব ক. Ravindranatha। তিনি জানান যে কর্ণাটকের রামানগরম শহরকে বলা হয় Silk City এবং ভারতের রেশম চাষের বেশির ভাগটাই এ জেলায় হয়ে থাকে। কর্ণাটকে সিল্ক উৎপাদন হয় প্রায় ৭৩৬০ মেঃ টন।
দুপুরে রেশম বিভাগের একজন কর্মকর্তা তার বাসায় আমাদেরকে আপ্যায়িত করেন যা ছিল আন্তরিকতায় ভরপুর। বেলা ৩:৩০টায় কর্ণাটক রাজ্য রেশম গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করা হয় এবং সেখানকার যুগ্ম পরিচালক মি. ই. Boraiah এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে রেশম শিল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনা থেকে জানা যায় রেশম তন্তু উৎপাদনে ভারতে পাঁচ রকমের সিল্কওয়ার্ম লালন করা হয়। এগুলো হলো Bombyx Mori(সবচেয়ে ভাল কোয়ালিটি), Antherea assama, Antherea mylitta, Antherea royeli এবং Antherea Permy। আমাদেরকে সেগুলো ল্যাবরেটরিতে দেখানো হয়। এরপর আমরা হোটেলে ফিরে আসি। তারপর রাতে শহরের এক বাঙালি হোটেলে ডিনার করি যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
পরদিন ২৫ জানুয়ারি সকাল ১০:০০টায় আমরা রেশম অধিদপ্তরের কমিশনার ড. এন নাগামবিকা দেবীর কার্যালয়ে তার সাথে ভারতের রেশম শিল্পের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করি। উল্লেখ্য, ড. দেবী একজন আইএএস অফিসার। তিনি আমাদের কাছে ভারতের সর্বশেষ রেশম শিল্পের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার বিষয়ে বিস্তারিত দিক তুলে ধরেন। বর্তমানে ভারতে স্বল্প বিনিয়োগে রেশম শিল্প থেকে কিভাবে বিনিয়োগকারীরা অধিকতর লাভবান হচ্ছে তারও ব্যাখ্যা দেন। এ খাত থেকে ইদানীং ভালো পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে বলে তিনি জানান। গত অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৮৭১.৯৯ কোটি ভারতীয় রুপী। দুপুরে আমরা লাঞ্চ করি ব্যাঙ্গালোর শহরের হোটেল ‘Empire’-এ।
সেদিন বিকেলে আমরা যাই ব্যাঙ্গালোর শহরের বিখ্যাত লালবাগ ফ্লাওয়ার পার্কে, যেখানে হাজারো রকমের ফুল দেখতে পাওয়া গেছে। সেখানে পুরো ফুল দিয়ে একটি মন্দির দেখতে পেলাম যা ছিল চমৎকার। তারপর আমরা গেলাম ‘National Mysore Reshom Emporium’-এ। সেখান থেকে আমরা কিছু কাপড়চোপড় কিনলাম। আমার মা এবং স্ত্রীর জন্য দুটো রেশমী কাপড় কিনলাম। রাতে আবার হোটেল ‘Empire’-এ খাওয়াদাওয়া করি।
পরদিন ২৬ জানুয়ারি ৬:২০ মিনিটে আমাদের প্রতিনিধি দল ব্যাঙ্গালোর ত্যাগ করে এবং কলকাতা হয়ে স্থানীয় সময় ১৪:৩৫ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছি।
৪ দেশে ১৩ দিনের ঐ ঝটিকা সফর স্বপ্নের মতো মনে হলেও স্মৃতিপটে জমে আছে অনেক কিছু যা আমাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে। রেশম শিল্প সম্পর্কে জেনেছি অনেক, যা আমাদের দেশের রেশম শিল্পোন্নয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন