বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ইয়োকোহামা সিল্ক মিউজিয়াম

ইয়োকোহামা সিল্ক মিউজিয়াম







জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হচ্ছে ইয়োকোহামা। এটা সমুদ্রবন্দর। ১৮৫৯ সালে উন্মুক্ত হয়। প্রায় ২০০ বছরের স্ব-আরোপিত নিষিদ্ধ-রাজ্যের কপাট উন্মুক্তকরণের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হয় জাপানে আধুনিকতার। বিগত ১৫০ বছরে য়োকোহামা মহানগরীর অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে সবদিক দিয়েই। এটি বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত একটি বন্দরনগরী। নয়নাভিরাম এই বন্দরনগরে রয়েছে একাধিক জাদুঘর। যেমন য়োকোহামা আর্কাইভস অব হিস্ট্রি, য়োকোহামা ডল মিউজিয়াম, য়োকোহামা মিউজিয়াম অব য়োরোপিয়ান কালচার্স, দি জাপানিজ নিউজপেপার মিউজিয়াম, য়োকোহামা স্ট্রিট কার মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব য়োকোহামা আরবান হিস্ট্রি, য়োকোহামা মিউজিয়াম অব আর্ট, মিৎসুবিশি মিনাতো মিরাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মিউজিয়াম, নিপ্পন মারু মেমোরিয়াল পার্ক, সোগো মিউজিয়াম অব আর্ট, য়োকোহামা হিস্ট্রি মিউজিয়াম প্রভৃতি। এগুলো প্রমাণ করে য়োকোহামার সঙ্গে দেশ-বিদেশের সম্পর্ক কত হৃদ্ধ ছিল।

জাদুঘর সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতিচ্ছবি এবং মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আধ্যাত্দিক শকট। আঠারো থেকে বিশ শতকে এশিয়ার কলকাতা, হংকং, সাংহাই, পেনাঙ, জাভা, নাগাসাকি, কোবে এবং য়োকোহামার মধ্যে ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগ। একে বলা যায় সামুদ্রিক সিল্করোড। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও আরব বণিকদের প্রধান বাণিজ্যিক পথই ছিল এই সমুদ্রপথ। মসলা, খাদ্য, আফিম, ধাতবসামগ্রী, সুতা, মসলিন, কাঁচা সিল্ক ইত্যাদি ছিল প্রধান বাণিজ্যিক পণ্য। কাজেই সিল্ক নিয়ে একটি মিউজিয়াম খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরেই। সেটা যে য়োকোহামাতে আছে তা জানতাম না।

গত বছর গ্রীষ্মকালে য়োকোহামাতে জাপান ভ্রমণরত ভারতের মণিপুর রাজ্যের একটি নৃত্যদল অনুষ্ঠান করতে আসে। আমন্ত্রণ পেয়ে যে ভবনে গেলাম সেটাই সিল্ক মিউজিয়াম। য়োকোহামা নগরীর নাকা-ওয়ার্ডে অবস্থিত এই জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে য়োকোহামা বন্দর উন্মুক্তির শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ১৯৫৯ সালে। যার বয়স এখন অর্ধশতাব্দী। জাদুঘরটি আধুনিককালে সিল্ক কীভাবে জাপানে বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে বিস্তার লাভ করল তাকে কেন্দ্র করে সজ্জিত হলেও একটা সিল্ক-সংস্কৃতি যে এদেশেও মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২) ও তাইশো যুগ (১৯১২-২৬) হয়ে শোওয়া যুগের (১৯২৬-৮৯) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল তার চিত্র এখানে পাওয়া যায়। তবে প্রাচীন ইতিহাস কিছু জানা যায় না। কবে সিল্ক জাপানে আমদানি হয়েছিল সে সম্পর্কে জানতে হলে গ্রন্থাগারেই যেতে হবে। তথাপি যেভাবে জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে তাতে করে স্পষ্টতই ধারণা হয় যে, সিল্ক জাপানের জন্য ছিল অপরিহার্য একটি বাণিজ্যিক উপাদান। সিল্ক দিয়ে তৈরি পণ্যসামগ্রী বহির্বিশ্বে রপ্তানির চিন্তা করেছে জাপান আঠারো শতকেই। ১৮৭৩ সালে ভিয়েনা শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় জাপান প্রথম সিল্কের রুমাল দিয়ে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। সেখানে জাপানি সিল্ক কারিগররা বিদেশে প্রযুক্তির সাহায্যে কীভাবে উন্নতমানের পণ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। সেই প্রযুক্তি জাপানও দ্রুত প্রয়োগ করে। তাছাড়া ব্রিটেনের কতিপয় সিল্ক পণ্য ব্যবসায়ীরাও আগ্রহ সহকারে য়োকোহামাতে ব্যবসা উন্মুক্ত করেন। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাপানি সিল্ক ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে হাত দেন। সিল্কের ব্র্যান্ড সামগ্রী তৈরি করে প্রভূত সাফল্য অর্জন করে কতিপয় প্রতিষ্ঠান। পণ্যের মধ্যে বড় রুমাল বা স্কার্ফ এখনো বিখ্যাত ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্ববাজারে বিদ্যমান। তারই নমুনাসমূহ এই জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিছু তথ্য খুঁজে পেয়ে আশ্চর্য হলাম যে, মধ্যযুগ তথা ১৬ শতকেই জাপানে 'বেঙ্গল সিল্ক' নামে অত্যন্ত উন্নতমানের কাঁচা সিল্ক জাপানে আমদানি এবং সমাদৃত হয়েছিল। দেশীয় বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়ে জাপানি সিল্ক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য এশিয়ার কোনো কোনো বাজারেও বিক্রি করতেন। কয়েক দশক পর্যন্ত এই সিল্ক আমদানি করে জাপান প্রভূত লাভবান হয়। তবে এই সিল্ক বাংলার কোন জায়গা থেকে আমদানি হতো বা কারা রপ্তানি করতেন গবেষণাসাপেক্ষ। সমুদ্রপথে পর্তুগিজ বা আরব বণিকরা এই ব্যবসা করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। কলকাতার তাম্রলিপি বন্দর অথবা পূর্ববঙ্গের চাটগাঁ বা সাতগাঁ সমুদ্রবন্দর থেকে এই সিল্ক ক্রয় করে বণিকরা জাপানের নাগাসাকি সমুদ্রবন্দরে এনে বিক্রি করতেন। তখন জাপানে সামুরাই তথা এদো যুগের (১৬০৩-১৮৬৮) সূচনা হয়েছে। অথবা সিল্কের জন্মস্থান চীন থেকে বীজ নিয়ে বাংলা অঞ্চলে সিল্কের চাষাবাদ হওয়ার ফলে সিল্কপথ ধরেও জাপানে ওই বেঙ্গল সিল্ক প্রবেশ করে থাকতে পারে। এই সিল্ক জাদুঘরে আরও দেখতে পেলাম সিল্কের তৈরি শাড়ি কাপড়সহ নানা ধরনের পোশাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আছে রেশমগুটি থেকে সুতা তৈরির চরকা, কাপড় তৈরির তাঁত মেশিন, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং নানারকম পণ্যের নমুনা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন