শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রেশম চাষে রঙিন স্বপ্ন

রেশম চাষে রঙিন স্বপ্ন
ম নজরুল ইসলাম লাভলু, কাপ্তাই 

রেশম চাষ করে ভাগ্য বদলানোর রঙিন স্বপ্নে বিভোর পার্বত্য এলাকার অসংখ্য পাহাড়ি-বাঙালি। ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে স্বপ্নের পথে পা দিয়েছেন ৩৪৯ জন নারী-পুরুষ। প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন আরও ৪০০ জন। 
রেশম চাষ বদলে দিতে পারে পার্বত্যবাসীর জীবনধারা_ এই স্লোগান ধারণ করে বেকার তরুণ-তরুণীদের রেশম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা আঞ্চলিক রেশম গবেষণা কেন্দ্র। পার্বত্য এলাকায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের রেশম চাষের ঘাটতি মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। 
সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় 'প্রজেক্ট অন সেরিকালচার রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি ডেসিমিনেশন ইন হিলি ডিস্ট্রিকস্' নামে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রকল্পের পুরো অর্থই ব্যয় করা হবে রেশম চাষে।
সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের অর্থ দিয়ে পাহাড়ি এলাকায় উপযোগী রেশম চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি তৃণমূল পর্যায়ে হস্তান্তর, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, গবেষণার মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকায় তুতজাত ও পলুজাতের অ্যাডাপটিবিলিটি পরীক্ষা, নন মালবেরি সেরিকালচারের ফেসিবিলিটি তৈরি, তুত ও পলু পোকার জামপল্গাজম সংরক্ষণ, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলে রেশম চাষ সম্প্রসারণ করা হবে। এর আগে পার্বত্য এলাকায় রেশম চাষ ছড়িয়ে দিতে প্রথম পযায়ে প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পে পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। প্রকল্পের আওতায় তখন প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স, রেশম চাষি কোর্স ও রিলিং এবং স্পিনিং কোর্সে ২৭৪ জন মহিলা এবং ৭৫ জন পুরুষ মিলে মোট ৩৪৯ জন পাহাড়ি-বাঙালি বেকার তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০৯-২০১২ সাল মেয়াদের এ প্রকল্পে আরও ৪০০ বেকার তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে (২৫ পৃষ্ঠার পর)
দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় সাড়ে সাতশ' বেকার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। 
এদিকে প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতিদের মধ্যে ১০০ জনকে গত অক্টোবর মাসে ২০ হাজার উন্নতজাতের তুত গাছ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনার বারঘোনা তংচঙ্গ্যাপাড়ার ২৫ জন, ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বটতলির ১০ জন, কাউখালী উপজেলার ৪০ জন, রাজস্থলী উপজেলা সদরের ১০ জন, এবং বাঙ্গালহালিয়ার ১৫ জন। তাদের প্রত্যেককে ২০০টি করে মোট ২০ হাজার তুত গাছ দেওয়া হয়। এসব চাষিকে প্রকল্পের আওতায় তিন বছর ধরে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ চাষি হিসাবে গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী সময়ে এসব চাষি নিজেরাই রেশম চাষের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদল করবেন। 
কাউখালী উপজেলার প্রশিক্ষিত রেশম চাষি ফেরদৌসি বেগম বলেন, 'চন্দ্রঘোনা আঞ্চলিক রেশম গবেষণা কেন্দ্র থেকে রেশম চাষ বিষয়ে স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর ২০০টি উন্নতজাতের তুতের চারা নিয়ে চাষ শুরু করি। এটা প্রায় চার বছর আগের কথা। এখন আমি সফলভাবে রেশম ও পুল পালনসহ রেশম সুতা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। একইসঙ্গে প্রতি মাসে কিছু অর্থ সঞ্চয়ও করছি।' রেশম চাষেই তার পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমার সফলতা দেখে এলাকার অনেক মহিলা রেশম চাষের আগ্রহী হয়েছেন। আগ্রহী এমন ৩০ মহিলাকে আঞ্চলিক রেশম গবেষণা কেন্দ্রের নতুন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ২০০টি করে তুত চারা দেওয়া হয়েছে।' 
কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা ইউনিয়নের আদিবাসী মঙ্গলশোভা চাকমা বলেন, গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ২০০টি তুত চারা পেয়েছি। প্রশিক্ষণ কাজ লাগিয়ে নিজেকে একজন দক্ষ রেশম চাষি হিসেবে গড়ে তোলাই মঙ্গলশোভার লক্ষ্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। 
রেশম চাষ করে স্বপ্নের জীবন গড়তে মুখিয়ে আছে মঙ্গলশোভার মতো অসংখ্য নারী। প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া জ্ঞান কাজে লাগিয়েই তারা নিজ ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। একইসঙ্গে চান দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে।
চন্দ্রঘোনা রেশম গবেষণা কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক কামনাশীষ দাস সমকালকে বলেন, 'রেশম চাষিরা উৎপন্ন রেশম গুটি সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। কিংবা গুটি থেকে সুতা উৎপাদন করেও বিক্রি করতে পারবেন। আর উইভাররা সুতা থেকে কাপড় তৈরি করে বিক্রি করতে পারবেন।' পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত আদিবাসীরা নিজেদের কাপড় নিজেরাই বুনন করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গুটি থেকে সুতা তৈরি করে সে সুতার সাহায্যে তারা নিজেদের পরিধেয় কাপড় তৈরি করে পরিধান করতে সক্ষম হবে। অবশিষ্ট কাপড় বিক্রি করে নিজ ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিরও উন্নয়ন ঘটাবে_ এটিই প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য।' তিনি আরও বলেন, 'দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন কাঁচা রেশম প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫০ মেট্রিক টন কাঁচা রেশম দেশে উৎপাদিত হয়। বাকি ২৫০ মেট্রিক টন রেশম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর পেছনে দেশের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে অবশিষ্ট রেশম বিদেশে রফতানি করে বিপুল অর্থ আয় করা সম্ভব হবে।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন