শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

শুধুমাত্র সরকারের অবহেলা আর গাফলতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে অপার সম্ভাবনাময় রেশম শিল্প






শুধুমাত্র সরকারের অবহেলা আর গাফলতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে 
অপার সম্ভাবনাময় রেশম শিল্প


রেশম চাষ এবং রেশম কি এ নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ অনেক। এ রেশম চাষ
 বাংলাদেশে হয় এবং এর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে তা অনেকের কাছে অজানা। 
মোগল আমলে রাজশাহীতে রেশম চাষের শুরম্ন। কাল পরিক্রমায় আজও রাজশাহীসহ
 দেশের বিভিন্ন এলাকায় রেশম চাষ হচ্ছে। আর এই রেশম চাষের পরিপ্রেক্ষিতে এক
 সময় রাজশাহী 'সিল্কনগরী' হিসেবে পরিচিত ছিলো। কারণ রেশম শিল্পকে কেন্দ্র
 করেই রাজশাহী নগরীর উৎপত্তি হয়েছে।রেশমের তৈরি লালপাড় গরদ শাড়ি, গরদের 
পাঞ্জাবি, আর মটকা শুধু দেশে জনপ্রিয় নয়, বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই রেশম
 চাষ দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
রেশম শিল্প পণ্য হিসেবে পরিচিত হলেও এটি একটি কৃষিপণ্য। তবে রেশম চাষ একটি ভিন্ন
 মাত্রার হয়ে থাকে। ধান, পাট, গম, ভুট্টা কিংবা শাক-সবজি উৎপাদনের মতো রেশম চাষ 
করা যায় না। কারণ অন্য কৃষিপণ্যের চাষাবাদের মতো রেশম উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
 এর জন্য দু’টি প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে। যেমন রেশম চাষের জন্য অপরিহার্য 
উপাদান তুঁত চাষ, তার জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং রেশম পোকা তথা 
পলু পালনের জন্য আর এক ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে। এ দু’টি পরিবেশই
অনুকূলে থাকতে হয় একই সময়। তবে রেশম চাষে সফলতা আসে।
রেশম চাষ নিয়ে অনেক কাহিনী, অনেক কিংবদন্তি থাকলেও রেশম সাধারণ মানুষের চাষযোগ্য
 পণ্য। এই রেশম শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৬ লাখ মানুষ জড়িত রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৪৮ মিলিয়ন
 টাকা মূল্যের ৪০ মেট্রিক টন কাঁচা রেশম উৎপন্ন হয়। তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। রাজশাহীতে
 এখন প্রায় ৭৫টি সিল্ক কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে রেশম সুতার চাহিদা ৩৫০ টন।
অবশিষ্ট সুতা আমদানি করতে হয়। এক সময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চীন, জাপান,
 কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কাজাখস্তান থেকে সুতা আমদানি করলেও বর্তমানে চীন বাদে 
অন্য সবকটি দেশ সুতা রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। দেশীয় উৎপাদন থাকায় কেবল চীনই নিজ চাহিদার 
বাইরেও রফতানি করছে।কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে চীনও এদেশে সুতা
 রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে। তখন নিশ্চিতভাবে চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে বাংলাদেশের রেশম শিল্প।
 মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যাবে প্রায় ৭৫টি বেসরকারি ছোট বড় রেশম কারখানা, ৬০০টি পাওয়ার লুম ও 
৩৫০টি হ্যান্ডলুম।অথচ বাংলাদেশের রেশম শিল্পের অস্তিত্ব সঙ্কটে কখনোই পড়ার কথা ছিলো না।
 কারণ ১৯৭৭ সালে রাজশাহীতে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন 
জেলা-উপজেলা ছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে রেশম চাষ। ৩৬ জেলার ১৯০টি উপজেলায়
 রেশম চাষের বিস্তার ঘটে। রাজশাহী ও রাঙামাটিতে স্থাপিত হয় রেশম গবেষণা ইন্সটিটিউট। রাজশাহী
 ও ঠাকুরগাঁওয়ে স্থাপিত হয় রেশম কারখানা।বৃহত্তর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও
 দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় রেশমগুটি উৎপাদন, তুঁত চাষ, পাতা উঠানো, বিক্রি, প্রিন্টিং,
 সেলিং, উইভিংসহ বিভিন্ন কাজে লাখখানেক মানুষ জড়িয়ে পড়ে। চাহিদার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ
 উৎপাদিত হতে থাকে দেশেই।১৯৯৭ সালে বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গঠিত সিল্ক
 ফাউন্ডেশনের অধীনে ব্র্যাক, প্রশিকা, আরডিআরএসসহ বেশ কিছু এনজিও তুঁত ও রেশম গুটি চাষের
 সম্প্রসারণের কাজ করানো হয়। এনজিও দিয়ে এ কাজ করানোয় সফলতা আসেনি। দাবি করা হয়,
 সে সময় শুধু তুঁতগাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক 
পরবর্তী সময়ে এ খাতে ফান্ডিং প্রত্যাহার করায় রেশম চাষের সবউদ্যোগ বিফলে যায়। বেকার হয়ে
 পড়ে অসংখ্য শ্রমিক। অনেকে এ পেশা ছেড়ে দেয়। সমগ্র উত্তরাঞ্চলে রেশম চাষের অবস্থা নাজুক হয়ে 
পড়ায় উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪০ টনে নেমে আসে। অথচ বাংলাদেশ যে গতিতে এগোচ্ছিল তাতে
 চাহিদার পুরো ৩০০ টনই উৎপাদন সম্ভব ছিলো। কিন্তু কিছু হটকারী সিদ্ধান্তের কারণে উৎপাদন না বেড়ে 
বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং এ শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসছে।দেশের রেশম শিল্পে প্রথম বিপর্যয় নেমে আসে 
১৯৯১ সালে। ওই বছর সরকারের বস্ত্র মন্ত্রণালয় বিশ্ব ব্যাংকের দোহাই দিয়ে ঢালাওভাবে বিনা শুল্কে রেশম 
সুতা আমদানির সুযোগ দেয়। এতে অপেশাদার ব্যবসায়ীরা চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুতা আমদানি
 করে। অতিরিক্ত সুতা পাচার হয়ে যায় পাশের দেশে। উৎপাদিত সুতার চেয়ে আমদানি করা সুতার দাম কম
 হওয়ায় চরমভাবে মার খায় রেশম শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা।অবস্থা উত্তরণে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর
 কোনো বিকল্প নেই। এজন্য অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতো বিনা সুদে ঋণ দিয়ে রেশম গুটি ও
 তুঁতগাছ চাষে কৃষকদের উৎসাহী করে তুলতে হবে। এনজিওগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে
 তুঁতগাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। যেসব পলুচাষী এ পেশা থেকে সরে গেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে
 কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে তোলার
 উপর গুরুত্ব দিতে হবে। যে দেশে রেশম বোর্ড, রেশম গবেষণা ইন্সটিটিউট, রেশম কারখানা ও অভিজ্ঞ রেশম
 চাষী আছে বর্তমানে সে দেশ তার চাহিদার ৩০০ টন রেশম অবশ্যই উৎপাদন করতে সক্ষম। এ জন্য
 প্রয়োজন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা।
তাই রেশম চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। কেননা বিশ্ববাজারে রেশম আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্ত্র 
সামগ্রী। তাই পলু চাষীদের সহায়তা দেয়া জরুরী। রেশম শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে রেশম চাষীদের 
বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন