ভূমিকা :প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের রেশম শিল্পের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তের পর রেশম সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ রেশম উৎপাদনকারী এলাকা ও প্রতিষ্ঠান ভারতীয় অংশে পড়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর অংশে সামান্য অংশ পড়ে যেগুলো বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। সেই বিগত দিন থেকেই সারা বিশ্বে রাজশাহীর রেশমের একটি সুখ্যাতি ছিল এবং এখন পর্যন্ত দেশে রেশম চাষ ও রেশম শিল্পের বিকাশ রাজশাহীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। সেই কারনে ১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকার রেশম শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে রেশম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের গ্রামে গঞ্জের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট-কে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়।
বাংলাদেশ রেশম বোর্ড ২০০২ সালে অতিহ্যবাহী রাজশাহী রেশম কারখানা ও ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানা বন্ধ করে দেয়।
এহেন পরিস্থিতিতে কিভাবে বাংলাদেশের রেশম শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো যায় সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণের মাধ্যমে রেশম শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি সার্ভে করত: বিশেষজ্ঞগণ বারেগপ্রইকে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড হতে পৃথক করার সুপারিশ করেন। এ সুপারিশের আলোকে তৎকালীন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৯৯৭ সালের ১১ আগষ্ট মন্ত্রী সভার বৈঠকে বারেগপ্রইকে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড হতে পৃথক করার সিদ্ধান্তানুযায়ী ২০০৩ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড হতে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট-কে পৃথক করে জাতীয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরাসরি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যাস্ত করা হয়। এর ফলে বারেগপ্রই এর গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের গতিশীলতা ফিরে আসে।
স্বতন্ত্র হিসেবে বারেগপ্রই এর সাফল্যঃ
১. বারেগপ্রই ইতোমধ্যে ৯টি উচ্চফলনশীল তুঁতজাত উদ্ভাবন করেছে যা মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার করার ফলে তুঁত পাতার উৎপাদন বিঘা প্রতি বার্ষিক ২,০০০ কেজি থেকে ৫,০০০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে।
২. ২৫টি উচ্চফলনশীল রেশম কীটের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যার মধ্যে মাঠপর্যায়ে ৮টি জাত ব্যবহার করার ফলে ১০০ ডিমে রেশম গুটির গড় উৎপাদন ২৫ - ৩০ কেজির স্থলে ৬০ - ৭০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে।
৩. পূর্বে ১টি রেশম গুটি হতে ২৫০ - ৩০০ মিটার সূতা পাওয়া যেত সেক্ষেত্রে বর্তমানে ৭০০ - ৮০০ মিটার সূতা পাওয়া যাচ্ছে।
৪. উন্নত তুঁতজাত ও উন্নত রেশম কীটের জাত মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের ফলে ১ বিঘা জমিতে তুঁতচাষ করে ১জন রেশম চাষী বছরে ১২০ কেজির স্থলে বর্তমানে ২৪০ কেজি রেশম গুটি উৎপাদন করছে । ফলে বর্তমানে একজন চাষী পূর্বের তুলনায় ২ - ২.৫০ গুণ বেশী মূল্য পাচ্ছেন।
৫. পূর্বে ১ কেজি রেশম সুতা পেতে ১৮ - ২০ কেজি রেশম গুটি প্রয়োজন হত। বর্তমানে সে স্থলে ৮ - ১০ কেজি গুটি প্রয়োজন হয়। ফলে ১ বিঘা রেশম চাষ করে বছরে ৬ কেজি সূতার স্থলে ২৪ কেজি রেশম সূতা পাওয়া যাচ্ছে।
৬. রেশম গুটি শুকানোর জন্য ড্রায়ার ও বিভিন্ন রিলিং মেশিনের কারিগরি উন্নয়ন সাধন করে এসব যন্ত্রপাতি বারেগপ্রই হতে তৈরী করা হচ্ছে। ফলে এসব যন্ত্রপাতি আমদানী করার প্রয়োজন হচ্ছে না এবং এসব যন্ত্রপাতি অর্ধেক মূল্যে তৈরী করা সম্ভব হচ্ছে।
৭. প্রশিক্ষণ কোর্সে পূর্বে বার্ষিক প্রশিক্ষণ প্রদানের গড় সংখ্যা ছিল ১২৭ জন, বর্তমানে বছরে ১৫৯ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
দেশে রেশম শিল্প বিকাশ ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (বারেগপ্রই) টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সম্প্রতি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বারেগপ্রই পরিদর্শন করেন এবং এ প্রতিষ্ঠান হতে উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নত তুঁতজাত, রেশমকীটের জাত এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পুংখানুপুঙ্খ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের আরও উন্নয়ন ও শক্তিশালী করণের জন্য কার্যক্রম গ্রহণের অভিমত ব্যক্ত করেন।
বর্তমানে চীন রেশম চাষ সংকোচন করায় আর্ন্তজাতিক বাজারে রেশম সূতার দাম বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত ও ভিয়েতনাম রেশম চাষ সম্প্রসারণ করছে। বাংলাদেশও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রেশম চাষে ব্যাপক সম্প্রাসারণ ঘটাতে পারে। এ লক্ষ্যে বারেগপ্রই স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তা বজায় থাকলে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কাজ ত্বরান্বিত করতে পারে এবং বাংলাদেশ রেশম বোর্ড ও রেশম চাষে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মাঠ পর্যায়ে রেশম চাষ সম্প্রসারণ কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে উপকৃত হতে পারে। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য দেশের অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট-কে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেখে যুগোপযোগী গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কাজে গতিময়তা আনার জন্য এ প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।-
-কামনাশীষ দাস, এসআরও, বিএসআরটিআই
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন