সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রাজশাহীর সিল্ক: এখনো সমান জনপ্রিয়



রাজশাহীর সিল্ক: এখনো সমান জনপ্রিয়


রাজশাহীর সিল্ক: এখনো সমান জনপ্রিয়

মেহেরুন হাসান সুজন


একসময় চীন তাদের ঐতিহ্যবাহী সিল্ক রফতানির পথ সুগম করার জন্য পুরো একটি রাস্তাই বানিয়ে ফেলে। ৩ হাজার বছর আগের সেই সিল্করুটকে এখনো ধরা হয় ব্যবসা-বাণিজ্যর পয়মন্ত হিসেবে। সিল্ক বা রেশম কাপড়ের এমনই আবেদন। মোগল আমল থেকেই রাজশাহীতে রেশম চাষের শুরু। সিল্ক কাপড়ের আলোয় একসময় রাজশাহী পরিচিত হতো সিল্ক নগরী হিসেবে। রেশম কাপড়ের লাল পাড় গরদ শাড়ি, গরদের পাঞ্জাবি, মটকা শাড়ি ছাড়া বাঙালির বিয়ে-পার্বণ কল্পনায় করা যেত না। বিবি রাসেলের হাত ধরে রাজশাহীর বলাকা সিল্ক ইউরোপেও আস্তানা গেড়েছে।
মেশিনে বোনা সস্তা কাপড়ের বাতাবরণে এখনো শক্তভাবেই টিকে আছে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক। সুতার দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সিল্ক কাপড়ের দাম। কিন্তু তাতেও রেশম কাপড়ের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ-উত্সাহ কমেনি। রাজশাহীর রেশম গুটির রেশমি শাড়ির মানই সবচেয়ে ভালো। এখানে জনপ্রিয় সিল্ক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায় ১ হাজার থেকে শুরু করে ৪৫ হাজার টাকার মধ্যে। ক্রেতাদের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে নতুন ডিজাইন বাজারে নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানগুলো। শত সংকটেও এখনো টিকে আছে রাজশাহীর প্রথম সারির সিল্ক প্রতিষ্ঠানগুলো। 
রাজশাহীর জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি। সপুরা সিল্কের বিসিক শিল্প এলাকার কারখানা শোরুমের ইনচার্জ সাইদুর রহমান জানান, মসলিনের ওপর কারচুপির কাজ করা ডিজাইনের শাড়িও এবার নতুনভাবে হাজির করেছে সপুরা। এসব শাড়ির দাম পড়বে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। অ্যান্ডি ও র-সিল্কের ওপর স্ট্রাইপ ও আর্ট করা নতুন ডিজাইনের শাড়িও রয়েছে সপুরা সিল্কে। এ শাড়িগুলো পাওয়া যাবে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। অ্যান্ডি ও র-সিল্ক মিলিয়ে ব্লকের কাজ করা নতুন ডিজাইনের শাড়িগুলোর দাম পড়বে ৭ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া ধুপিয়ান ও বলাকা সিল্কের শাড়িগুলো পাওয়া যাচ্ছে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। আগামী ঈদের ডিজাইন হিসেবে নতুন ধরনের কাতান শাড়ি তৈরি করছে সপুরা, যার দাম পড়বে ৪ হাজার ২০০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে সম্প্রতি বাজারে এসেছে শিপন থান নামের নতুন এক ধরনের সিল্ক শাড়ি। ৪ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে এ শাড়ি পাওয়া যাবে। সপুরা সিল্কের রয়েছে সাতটি শোরুম। এর মধ্যে দুটি রাজশাহীতে, তিনটি ঢাকার গুলশান, শান্তিনগর ও ধানমন্ডিতে তিনটি এবং চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে আছে একটি করে শোরুম।
রাজশাহী আরেকটি জনপ্রিয় সিল্ক প্রতিষ্ঠান ঊষা সিল্কের বিসিক শিল্প এলাকার শোরুম ইনচার্জ নূর আলম বুলবুল বণিক বার্তাকে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে সিল্কের শাড়িগুলো ৯৫০ থেকে শুরু করে ১০ হাজার ৩০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। ক্রেতারা তাদের শোরুমে গিয়ে নিজেদের পছন্দের শাড়িটি কিনতে পারবেন বলে জানান বুলবুল। রাজশাহীতে দুটি এবং বগুড়া ও ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি করে শোরুম রয়েছে ঊষা সিল্কের।
তুঁত-পলু পোকা মিলে সিল্ক : সপুরা সিল্কের পরিচালক সাজ্জাদ আলী জানান, পলু পোকা থেকে তৈরি হয় সিল্কের সূতা। এরপর সে সূতা থেকে আসে বাহারি ডিজাইনের সিল্কের পোশাক। এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি জানান, প্রথমে সাদা রঙের পলু পোকা সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই পোকাকে একটি নির্দিষ্ট ট্রেতে রেখে তাতে ছড়িয়ে দেয়া হয় তুঁতগাছের পাতা। এ পাতা খেয়েই পলু পোকা পূর্ণাঙ্গ দেহ অবয়ব পায়। পাতা খেতে খেতে এক সময় পলু পোকা হলুদাভ রঙ ধারণ করে। তখন এটিকে আর পাতা খেতে দেয়া হয় না, রাখা হয় আলাদা ট্রেতে। সেখানে এটি পুরোপুরি হলুদ হয়ে শক্ত আকার ধারণ করে। তারপর এটিকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে ওপরের হলুদ খোসা সরিয়ে ফেলা হয়, বেরিয়ে আসে রেশম সুতার গুটি। এরপর ইলেকট্রিক চরকায় এ গুটি বসিয়ে বের করে নেয়া হয় রেশম সুতা। এ সূতা আরও প্রক্রিয়াজাত করে চলে যায় বুনন কারখানায়। সেখানে শ্রমিকরা বিভিন্ন ডিজাইনমাফিক সুতা বসিয়ে তৈরি করেন শাড়িসহ রঙবেরঙের সিল্কের পোশাক। পলু পোকা থেকে এভাবেই আসে রেশম বা সিল্ক পোশাক।
সপুরা সিল্কের পরিচালক সাজ্জাদ আলী জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত প্রায় ৩০০ কর্মচারী কাজ করেন। প্রতিদিন চলে শ’খানেক যন্ত্রচালিত লুম (তাঁত)। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভোলাহাটসহ রাজশাহীর আশপাশের এলাকায় চুক্তিভিত্তিক আরও প্রায় ৫ হাজার মানুষ কাজ করেন এ প্রতিষ্ঠানে। তারা মূলত কাঁচামাল সরবরাহ করেন। শ্রমিকরা নিজেদের বাগানে পলু পোকার চাষ করে সুতার জোগান দেয় সপুরায়।
ঊষা সিল্কের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মাহবুবুল হক জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৩০ শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন চলে ১০টি যন্ত্রচালিত লুম। তিনি আরও জানান, তারা সিল্কের কাঁচামাল বা সুতার প্রায় সবটাই আমদানি করেন চীন থেকে। তাদের নিজস্ব কোনো রেশম বাগান নেই। কিন্তু চীন সুতার দাম দিন দিন বাড়িয়ে দেয়ায় তারা বেশ সমস্যায় পড়েছেন। দেশে সুতার উত্পাদন বাড়াতে না পারলে সিল্কশিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 
১৯৭৭ সালে রাজশাহীতে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে রেশম চাষ। ৩৬ জেলার ১৯০টি উপজেলায় রেশম চাষের বিস্তার ঘটে। রাজশাহী ও রাঙামাটিতে আছে রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউট। রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁওয়ের রেশম কারখানার রেশমি কাপড় তার অনিন্দ্য সৌন্দর্য প্রকাশ করে চলেছে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন