আম ও রেশম
আম
ভোলাহাট উপজেলার আর এক সোনালী ফসল, আম ফল। সুস্বাদু আর সুমিষ্টি রসে টুইটম্বর ভোলাহাট-এর আম অতীতে মালদহী আম হিসেবে বহুকাল পূর্ব হতেই সুপরিচিত ও জগৎ বিখ্যাত। ভোলাহাট-এর দো-আঁশ মাটি আম চাষের খুবই উপযোগী। পরিবেশ ও আবহাওয়াও এর জন্য যথেষ্ট অনুকূল। এ জন্য ঐতিহাসিক বুকানন হ্যামিল্টন বলেছেন, মালদহের আম পৃথিবীর যাবতীয় ফলের মধ্যে সব চেয়ে উৎকৃষ্ট ফল। নবাব মুর্শিদকূলী খান, তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য মালদহের আম মজুদ রাখতেন। এ জন্য আমের মওসুমে সেনাবাহিনী দ্বারা আমের বাগান পাহারা দিতে হতো।
বুকানন হ্যামিল্টন বলেছেন উৎকৃষ্ট জাতের আম কেবল মাত্র ইংরেজ বাজারের বিপরীতে মহানন্দা নদীর তীরে পুরাতন মালদহে জন্মে। মিস্টার বুকাননের আমলে মালদহে প্রতি বছর ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার আম বিক্রি হতো। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার টাকার কেবল চারা গাছই বিক্রি হতো।
কখন হতে এ অঞ্চল তথা অবিভক্ত বাংলায় আম চাষের সূত্রপাত হয়েছে, তার কোন সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবে বহুপূর্ব হতে এ অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ ফল আম যে অতি জনপ্রিয় ছিল এবং আম গাছ হতে রাজস্ব আদায় করা হতো তা জানা যায়। পাল শাসনামলে ৫ম বৌদ্ধ রাজা নারায়ণ পাল দেবের (৯০০ খ্রিঃ -৯২৫ খ্রিঃ) ভূমি দান সংক্রান- একটি তাম্র লিপি হতে জানা যায়, দানকৃত গ্রামের চতুঃপার্শ্বস' গো চারণ স্থানে, গ্রামস' আম্রমধুক (সুস্বাদু সুমিষ্টি আম/মোহুয়া) বৃক্ষে দান গ্রহীতার রাজস্ব আদায় অধিকার দেয়া হতো।২ এ তথ্য হতে সহজেই সিদ্ধানে- উপনিত হওয়া যায় যে, বহুপূর্ব হতে বাংলায় আম চাষ হতো এবং সে সময়ও যে আম উৎকৃষ্ট, সুস্বাদু, সুমিষ্টি ফল হিসেবে জনপ্রিয় ছিল তাও জানা যায়। এছাড়াও আম গাছে বা আম ফলে রাজস্ব (কর) ধার্য্য করা হতো, তাও অবগত হওয়া যায়। এরও পূর্বে ১৮৯৩ খ্রিঃ এ উপজেলার ২নং গোহালবাড়ী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড খালিমপুর হতে ২য় বৌদ্ধ রাজা ধর্মপালদেবের ৩২তম বর্ষের রাজত্বকালের প্রাপ্ত একটি তাম্র পট্টলিতে ২টি আম প্রধান অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। যথা আম্রযানকোলাদ্ধজনিকা (আম বাগান সংলগ্ন খাল) ও স্থালীক্কট বিষয়ের অধীন আম্রষন্ডিকা মন্ডল। এতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, অত্র অঞ্চল বহু পূর্ব হতেই আমের জন্য বিখ্যাত বলে উল্লিখিত নাম দু’টির নামকরণ হয়েছে।
অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলা হতে বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে কলিকাতা ও ঢাকার বাজারে প্রতি বছর গড়ে ৫ লাখ টাকার আম রফতানী করা হত। ১৯০৭ খ্রিঃ মালদহ জেলায় ৫০ হাজার একর জমিতে আম বাগান ছিল। মালদহ সদর হতে দক্ষিণ পূর্বে মহানন্দা নদীর তীর অঞ্চল আম চাষের উপযুক্ত ভূমি।৪ ভূতপূর্ব মালদহ জেলার মহানন্দা নদীর তীরের সেই দক্ষিণ-পূর্ব ভূমি সাবেক রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার বর্তমানের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অনর্-ভূক্ত। এরমধ্যে ভোলাহাট উপজেলার অন্যতম। ভোলাহাট অঞ্চলের সুস্বাদু ও উৎকৃষ্ট মানের আম, মালদহী আম নামে এর সুনাম উপমহাদেশ ছাড়াও ইংরেজ বনিকদের দ্বারা ইউরোপও পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরেও এ অঞ্চলের আম ঐতিহ্যবাহী মালদহী আম নামেই ব্যপক পরিচিত ছিল। কেন না, জেলা সদর সংলগ্ন থানা ছিল আজকের ভোলাহাট বলেই।
বাংলাদেশের ফল মূলের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার আমই ফলের রাজা বা র্সবশ্রেষ্ঠ ফল বলে অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে গেছেন। ভোলাহাট উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান- এলাকা ঘন শামল ও বিশাল আম্রকুঞ্জ বলে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে বলেছেন বিশাল আম্র অভয়ারণ্য। এর মধ্যে সাবেক শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা সচিব কাজী জালাল আহ্মেদ- এর আম বাগান বিখ্যাত। এ আম বাগানে একটি প্রাচীন মসজিদ ও কাজী পরিবারের পারিবারিক কবর স্থান বিদ্যমান। এ স্থানটির কয়েক জায়গায় সমপ্রতিকালে সিমেন্ট এর তৈরী আসন ও ছাতা তৈরী করা হয়েছে। বর্তমানে পিকনিক কর্ণার হিসেবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উল্লিখিত স্থান ছাড়াও উপজেলার সর্বত্রই আম বাগান রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে লাগানো আম গাছের দৃশ্য সত্যই অপরূপ মনোহর। বাংলার অপূর্ব রূপ লাবন্য দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ছায়া ঢাকা ঘন শ্যামলিমায় আম্র নিকুঞ্জ ভোলাহাট-এর প্রাকৃতিক পরিবেশকে করেছে সুশোভিত। ঋতুরাজ বসনে-র আগমনে আম বাগানগুলি মুকুলিত হয়ে অপূর্ব রূপ ধারণ করে। পাগল করা মৌ মৌ গন্ধে মাতিয়ে রাখে ভোলাহাট-এর সামগ্রিক পরিবেশ সর্বক্ষণ। তখন নোবেল বিজয়ী বিশ্ব কবি রবি ঠাকুরের ভাষায় গুণগুণ করে গাইতে ইচ্ছে করে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে ............। আমাদের জাতীয় সংগীতে এর প্রকৃত রূপ মাধুর্য ফুটে উঠেছে। ঝড়ে মূখে ভর দুপুর কিংবা অতি প্রত্যুষে আম কুড়াণো যে কি মজা, তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়।
বুকানন হ্যামিল্টন বলেছেন উৎকৃষ্ট জাতের আম কেবল মাত্র ইংরেজ বাজারের বিপরীতে মহানন্দা নদীর তীরে পুরাতন মালদহে জন্মে। মিস্টার বুকাননের আমলে মালদহে প্রতি বছর ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার আম বিক্রি হতো। গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার টাকার কেবল চারা গাছই বিক্রি হতো।
কখন হতে এ অঞ্চল তথা অবিভক্ত বাংলায় আম চাষের সূত্রপাত হয়েছে, তার কোন সুনির্দিষ্ট ইতিহাস পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবে বহুপূর্ব হতে এ অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ ফল আম যে অতি জনপ্রিয় ছিল এবং আম গাছ হতে রাজস্ব আদায় করা হতো তা জানা যায়। পাল শাসনামলে ৫ম বৌদ্ধ রাজা নারায়ণ পাল দেবের (৯০০ খ্রিঃ -৯২৫ খ্রিঃ) ভূমি দান সংক্রান- একটি তাম্র লিপি হতে জানা যায়, দানকৃত গ্রামের চতুঃপার্শ্বস' গো চারণ স্থানে, গ্রামস' আম্রমধুক (সুস্বাদু সুমিষ্টি আম/মোহুয়া) বৃক্ষে দান গ্রহীতার রাজস্ব আদায় অধিকার দেয়া হতো।২ এ তথ্য হতে সহজেই সিদ্ধানে- উপনিত হওয়া যায় যে, বহুপূর্ব হতে বাংলায় আম চাষ হতো এবং সে সময়ও যে আম উৎকৃষ্ট, সুস্বাদু, সুমিষ্টি ফল হিসেবে জনপ্রিয় ছিল তাও জানা যায়। এছাড়াও আম গাছে বা আম ফলে রাজস্ব (কর) ধার্য্য করা হতো, তাও অবগত হওয়া যায়। এরও পূর্বে ১৮৯৩ খ্রিঃ এ উপজেলার ২নং গোহালবাড়ী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড খালিমপুর হতে ২য় বৌদ্ধ রাজা ধর্মপালদেবের ৩২তম বর্ষের রাজত্বকালের প্রাপ্ত একটি তাম্র পট্টলিতে ২টি আম প্রধান অঞ্চলের নাম পাওয়া যায়। যথা আম্রযানকোলাদ্ধজনিকা (আম বাগান সংলগ্ন খাল) ও স্থালীক্কট বিষয়ের অধীন আম্রষন্ডিকা মন্ডল। এতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, অত্র অঞ্চল বহু পূর্ব হতেই আমের জন্য বিখ্যাত বলে উল্লিখিত নাম দু’টির নামকরণ হয়েছে।
অবিভক্ত বাংলার মালদহ জেলা হতে বিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে কলিকাতা ও ঢাকার বাজারে প্রতি বছর গড়ে ৫ লাখ টাকার আম রফতানী করা হত। ১৯০৭ খ্রিঃ মালদহ জেলায় ৫০ হাজার একর জমিতে আম বাগান ছিল। মালদহ সদর হতে দক্ষিণ পূর্বে মহানন্দা নদীর তীর অঞ্চল আম চাষের উপযুক্ত ভূমি।৪ ভূতপূর্ব মালদহ জেলার মহানন্দা নদীর তীরের সেই দক্ষিণ-পূর্ব ভূমি সাবেক রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার বর্তমানের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অনর্-ভূক্ত। এরমধ্যে ভোলাহাট উপজেলার অন্যতম। ভোলাহাট অঞ্চলের সুস্বাদু ও উৎকৃষ্ট মানের আম, মালদহী আম নামে এর সুনাম উপমহাদেশ ছাড়াও ইংরেজ বনিকদের দ্বারা ইউরোপও পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরেও এ অঞ্চলের আম ঐতিহ্যবাহী মালদহী আম নামেই ব্যপক পরিচিত ছিল। কেন না, জেলা সদর সংলগ্ন থানা ছিল আজকের ভোলাহাট বলেই।
বাংলাদেশের ফল মূলের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার আমই ফলের রাজা বা র্সবশ্রেষ্ঠ ফল বলে অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা দিয়ে গেছেন। ভোলাহাট উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান- এলাকা ঘন শামল ও বিশাল আম্রকুঞ্জ বলে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে বলেছেন বিশাল আম্র অভয়ারণ্য। এর মধ্যে সাবেক শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা সচিব কাজী জালাল আহ্মেদ- এর আম বাগান বিখ্যাত। এ আম বাগানে একটি প্রাচীন মসজিদ ও কাজী পরিবারের পারিবারিক কবর স্থান বিদ্যমান। এ স্থানটির কয়েক জায়গায় সমপ্রতিকালে সিমেন্ট এর তৈরী আসন ও ছাতা তৈরী করা হয়েছে। বর্তমানে পিকনিক কর্ণার হিসেবে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উল্লিখিত স্থান ছাড়াও উপজেলার সর্বত্রই আম বাগান রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে লাগানো আম গাছের দৃশ্য সত্যই অপরূপ মনোহর। বাংলার অপূর্ব রূপ লাবন্য দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ছায়া ঢাকা ঘন শ্যামলিমায় আম্র নিকুঞ্জ ভোলাহাট-এর প্রাকৃতিক পরিবেশকে করেছে সুশোভিত। ঋতুরাজ বসনে-র আগমনে আম বাগানগুলি মুকুলিত হয়ে অপূর্ব রূপ ধারণ করে। পাগল করা মৌ মৌ গন্ধে মাতিয়ে রাখে ভোলাহাট-এর সামগ্রিক পরিবেশ সর্বক্ষণ। তখন নোবেল বিজয়ী বিশ্ব কবি রবি ঠাকুরের ভাষায় গুণগুণ করে গাইতে ইচ্ছে করে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে ............। আমাদের জাতীয় সংগীতে এর প্রকৃত রূপ মাধুর্য ফুটে উঠেছে। ঝড়ে মূখে ভর দুপুর কিংবা অতি প্রত্যুষে আম কুড়াণো যে কি মজা, তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়।
ঐতিহ্যবাহী আমের দেশ ভোলাহাট উপজেলায় গোপালভোগ, খিরসাপাতী, ল্যাংড়া, ফজলী ও আশ্বিনাসহ নানা প্রজাতির জগৎখ্যাত আম জন্মে।
অখন্ড মালদহ-এর তৎকালিন কালেক্টর মিঃ র্যাভেল খড়া পীড়িত প্রচন্ড তাপের ভর দুপুরে পিপাসার্ত হয়ে মালদহ জেলার কোতুওয়ালী গ্রামের এক রমনীর নিকট পানি পান করতে চাইলে, ফজলী বিবি নাম্মী ঐ মহিলা পানিসহ একটি পাকা আম মিঃ র্যাভেল সাহেবকে খেতে দেন। এতে মিঃ র্যাভেল খুশি হয়ে ঐ রমনীর নামানুসারে এ জাতের আমের নাম “ফজলী” রেখে যান বলে এক গল্প প্রচলিত রয়েছে। এ হতে ঐ আমের নাম “ফজলী” হয় বলে কিংবদন-ী রয়েছে। মাযহারুল ইসলাম তরুর মতে, পুরাতন মালদহের নিকটে নিমাসরাই নামক স্থানে ফজলী বিবি নামক জনৈক মহিলা সর্ব প্রথম ফজলী আমের গাছ লাগিয়ে ছিলেন। তার নামানুসারেই ফজলী আমের নাম করণ হয়।
ভোলাহাট উপজেলায় ১৯৭০ ও ৮০ এর দশকে আমের মূল্য ছিল অতি কম। তখন আম চাষ খুব একটা লাভ জনক ছিল না। মূলতঃ সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ঐ অবস্থা হয়েছিল। সে সময় এ অঞ্চলের একমাত্র পরিবহন মাধ্যম ছিল নৌকা। ফলে কাঁচা মাল পৌছাতে প্রচুর সময় লাগতো। অনেক সময় আম পচে নষ্ট হয়ে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পরতো। এছাড়া ঐ সময় আম অপেক্ষা রেশম চাষ ছিল অত্যন- লাভজনক। অপর দিকে রেশম সূতা আহরণের জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর জ্বালানী কাঠের। ফলে ঐ সময় নির্বিচারে আম গাছ কেটে সয়লাব করা হয়। বর্তমানে খোলা বাজার অর্থনীতির কারণে মার খেয়েছে রেশমের বাজার। বর্তমান বাজারে আমের মূল্য চাঙ্গা হওয়ায় রেশম চাষীরা রেশম চাষ ছেড়ে তুঁত জমিগুলিকে আমের বাগানে পরিণত করেছে। আর অত্রাঞ্চলের লোকের আম গাছ লাগানোর প্রবনতাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচুর আম গাছের চারা ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। একটি মাঝারি আম গাছ বছরে ৫-৬ হাজার টাকা মূল্যের আম উৎপাদন করে। ১ বিঘা জমির আম বাগান হতে বর্তমানে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। বছরে প্রায় ১০ হতে ১৫ কোটি টাকার আম কেনা-বেচা হয়ে থাকে ভোলাহাটে।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ভোলাহাট অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ৯শ ৫২ একর জমিতে আম চাষ হয়ে থাকে। আম গাছের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ৩ হাজার ৩শ ৭৫টি। তবে এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বার্ষিক আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার ২শ মেট্রিক টন।
আমের মৌসূমে অনেক গরীব মানুষ আম বাগান পাহারা দিয়ে ও আম কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। আমের সাহায্যে আচার, আমসত্ব , আমচুর তৈরী হয়। এখানে কাঁচা মালের সহজ প্রাপ্যতা সত্বেও গড়ে উঠেনি হিমাগার বা আম প্রক্রিয়াজাতকরণ জুস, আচার, জ্যাম, জেলী’র কারখানা। ফলে প্রতি বছর প্রচুর আম বিনষ্ট ও অপচয় হয়। এলাকায় হিমাগার ও আম প্রক্রিয়াজাত করণ কারখানা স্থাপন করা হলে যেমন বেকারত্ব লাঘব ও কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি পাবে, তেমনি আম চাষীরাও পাবে আমের ন্যায্য মূল্য।
রেশম
চির সবুজের লীলাভূমি, সত্যিকারের সোনালী জনপদ ভোলাহাট উপজেলা। তিনটি সম্পদ ভোলাহাটকে দিয়েছে ঐশ্বর্য্যশালীনির মর্যাদা। রত্নগর্ভা বললে অতিরিক্ত বলা হয় না।
ডালে, ডালায় ও ঢ্যালায় (মাটিতে) উৎপাদিত রত্ন ভোলাহাটবাসীর মর্যাদাকে উর্ধে করেছে সমাসিন। ডালে আম, ডালায় রেশম আর ঢ্যালায় ধান। ভোলাহাটের মাটি বসে ভরা। এর রসের ডালায় সোনালী রং এর রেশম, অন্যটি গাছের ডালে পরিপক্ক হলুদ রং এর সোনালী আম, মাটির ঢ্যালায় আর একটি সোনালী ধান। তাই বলতে হয় ভোলাহাট-এর মাটির রসে লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। এ কারণেই এ উপজেলাকে অনেকে সোনালী জনপদ বলে থাকে।
রেশম এলাহী প্রদত্ত সৃষ্টি লিলার এক গভীরতম রহস্য। রেশম কীট বা পলু তুঁত পাতা ভক্ষণে পরিণত বয়সে মুখের লালা নির্গত করে আস্তরণ সৃষ্টি করে, তারই শরীর ঘিরে। রেশম কীট বা পলুর লালা বাতাসের সংস্পর্সে আসার সংগে সংগে শুকিয়ে আঁশ ও গুটি পুন্ডলীতে রূপান-রিত হয়। বলা যায়, রূপ বদলের এক অনুপম সৃষ্টি এ রেশম কীট। পলুর মূখ দিয়ে নিস্বরিত লালার রূপ বদলের পরিবর্তীত আঁশ হতেই আসে সোনালী তন' বা রেশম সূতা। যাকে আমরা রেশম গুটি বা পুন্ডলী বলে থাকি।
আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে জীবনের ক্রানি-লগ্নে নিজেই কবর তৈরী করে শেষ পরিণতিতে মথ হয়ে শায়িত থাকে। রেশম গুটি না শুকালে এর অভ্যান-রের মথ শুপ্ত অবস্থায় জীবিত থাকে। গুটি তৈরীর ৪/৫ দিনের মধ্যে ঐ মথ হতে স্বয়ংক্রীয়ভাবে গুটির আস-রণ ভেদ করে (গুটি কেটে) প্রজাপতি রূপ ধারণ করে পুন্ডলী হতে বেড়িয়ে আসে। মথ রূপান-রিত প্রজাপতির মূখে থাকে এক ধরণের পচনশীল তরল পদার্থ। এর সাহায্যে গুটির পুন্ডলী সামান্য পচন ও নরম করে প্রজাপতি সহজেই গুটির পুন্ডলী ভেদ করে বেড়িয়ে আসে। স্থানীয় ভাষায় একে চকরী বলে। এ চরকী পুরুষ চরকীর সাথে ক্রস বা মিলন ঘটিয়ে শুরু করা হয় ডিম দেয়া পর্ব। একটি সুস'্য ও জীবানু মুক্ত চরকী ১ হতে ৪শ পর্যন- ডিম বীজ দিতে পারে। এ ডিম বীজ হতে ৪/৫ দিনের মধ্যেই গজাতে থাকে অতি ক্ষুদ্র আকৃতির কালো রং এর রেশম পোকা। এ পোকা ৭/৮ দিনের মধ্যেই সাদা রং ধারণ করে। প্রায় ১৫-২০ দিনের মধ্যে রেশম কীট বা পলু তুঁত পাতা খেয়ে পরিপক্ক হয়ে পুণরায় গুটি তৈরী করে রেশম চাষীর চন্দ্রর্কীতে। সত্যই কি অদ্ভুদ, কি বিচিত্র রেশম কীটের জীবন চক্র। যা চোখে না দেখলে বর্ণনা করা যায় না।
রেশম এমনই এক বস্ত্র যাকে পরিধাণ করলে মানব মনে অহংকার জাগতে পারে। আর রেশম নাকি বেহেস্তি পোষাক। এ কারণে ইসলামের দৃষ্টিতে একে পরিধাণ করে নামাজ আদায় না জায়েজ বলে অনেক ইসলামী পন্ডিত ব্যক্তি মতামত ব্যক্ত করেছেন।
রেশমের আদী পর্বঃ
রেশমের স্বর্ণ সূতিকাগার নামে খ্যাত, রেশমের ভান্ডার বা রেশম শিল্পের প্রাণ কেন্দ্র ভোলাহাট উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে রেশম শিল্পের সাথে জড়িত। দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ৭৫ ভাগ রেশম গুটি ও সূতা এখানেই উৎপাদিত হয় বলেই উপরিল্লিখিত বিশেষণে ভূষিত করা হয়ে থাকে।
রেশমের স্বর্ণ সূতিকাগার নামে খ্যাত, রেশমের ভান্ডার বা রেশম শিল্পের প্রাণ কেন্দ্র ভোলাহাট উপজেলার অধিকাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে রেশম শিল্পের সাথে জড়িত। দেশের মোট উৎপাদনের শতকরা ৭৫ ভাগ রেশম গুটি ও সূতা এখানেই উৎপাদিত হয় বলেই উপরিল্লিখিত বিশেষণে ভূষিত করা হয়ে থাকে।
স্বর্ণ প্রসবিনী ঐতিহাসিক গৌড়ের অংশ হিসেবে সত্যই স্বর্ণ তন্ত্র জন্ম দিয়ে থাকে এ ভোলাহাট উপজেলা। কাঁচা সবুজ তুঁত পাতা খেয়ে যে কীট মূখের লালা নির্গত করে আস্তরণ তৈরী করে, তারই শরীর ঘিরে তাকেই বলা হয় রেশম গুটি বা পুন্ডলী। এ গুটি হতেই আসে সোনালী তন' বা আঁশ। যাকে আমরা কাঁচা রেশম বলে থাকি।
এ সোনালী তন' বা সূতায় রেশমের সমস্ত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে বলে এ আঁশকে আদর্শ তন' বা সকল তন'র রাণী বলা হয়ে থাকে। ফরাসী ভাষায় রেশমী শব্দ হতে রেশম শব্দের উৎপত্তি। রেশমের নাম বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রচলিত আছে। রেশমকে চীনা ভাষায় “শী”, কোরিয়ান ভাষায় “সির বা সুই”, গ্রীক ভাষায় “সেরিকন”, জাপানী ভাষায় “কাইকো”, রুশ ভাষায় “সিওলক”, ফরাসী ভাষায় “সোয়ি”, ল্যাটিন ভাষায় “সেরিকন”, ইউরোপে বলে “সিল্ক ওয়ার্ম”, ব্রহ্ম দেশে “সা”, পাক ভারতে “রেশম, রেশম কীট বা পলু” এবং ইংরেজী ভাষায় “সিল্ক” আর বাংলা নাম গরদ বলে।
রেশম শিল্প সংক্রান- বিভিন্ন বই পুস-ক হতে জানা যায়, রেশমের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০০ বছর পূর্বে চীন দেশে। চীনের ষাস্টান প্রদেশের সম্রাট হোয়াংচির মতানে- ফোহির সম্রাজ্ঞী সীলিচি এক বাগানে গুটির পুন্ডলী আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে বহু গবেষণা ও সমপ্রসারণ করে প্রায় ১ হাজার বছর যাবৎ চীনের (ফরবিডেন সিটি) নিষিদ্ধ নগরীতে অতি গোপনীয়তার সাথে সংরক্ষণ ও আয়ত্বে রাখা হয়। পরবর্তীকালে দুইজন বৌদ্ধ ভিক্ষু মতানে- পারসিক সন্যাসী রেশম সমপর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও বীজ সংগ্রহ করে কনস্টান্টিনোপলে (আধুনিক ইস-াম্বুল) সরবরাহ করে।
পাক ভারত উপমহাদেশে রেশম চাষ সম্পর্কে প্রবাদ আছে যে, কাস্মীর দেশীয় নাগ বংশীয় এক রাজ পূত্রের সংগে চীন দেশীয় রাজ কন্যার বিবাহের পর স্বামীগৃহে যাত্রার প্রাক্কালে রাজ কুমারী কিছু রেশম ডিম বীজ কবরীর মধ্যে লুকিয়ে (খোপা) কাস্মিরে নিয়ে আসে।৩
টলেমী, প্লিনী প্রমূখ প্রাচীন লেখকেরা চীন দেশকে রেশমের আদিবাস বলে গ্রহণ করলেও জেমস্ টেলর বাংলাদেশেই প্রথম রেশম উদ্ভাবন হয় বলে অনুমান করেন। টেলরের অনুমানের স্বপক্ষে এ উপমহাদেশে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে রেশমী বস্ত্রের উল্লেখ কে উপস্থাপন করা যায়। রামায়ন, মহাভারতে রেশমী বস্ত্রের উল্লেখ আছে। মনুসংহিতায় আছে তসর ও রেশমের কথা।
শ্লোকে বগুড়ার মহাস্থান কেন্দ্রীক পৌন্ড্রবর্ধন রাজ্যের কোষাগার তথা রেশম উৎপাদনকারী জনপদের কথা জানা যায়। পুন্ড বা পুন্ড্রক কিংবা পৌন্ড্র শব্দের অর্থই এক প্রাচীন জাতি বিশেষ। যারা উত্তর বংগের অধিবাসী। অর্থাৎ এ স্থানে প্রাচীন বাংলাদেশেরই কথা আসে।৪ পৌন্ড্র শব্দটির অর্থ হলো রেশম।৫ বানভট্ট রচিত (৬ষ্ঠ ৭ম শতাব্দী) হর্ষ চরিতে যে পৌন্ড্র বাসের উল্লেখ রয়েছে। সেটেই উত্তর বংগীয় রেশম বস্ত্র বলে ধরে নেয়া হয়। চানুক্যের অর্থ শাস্ত্রে পৌন্ড্রবর্ধনের উৎকৃষ্ট রেশম বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে যে, যে পোকা পাতা খেয়ে মূখের লালা নির্গত করে যে আঁশ উৎপন্ন করতো, তাকে পত্রৌর্ণ বলা হত।
উত্তর বঙ্গে রেশম পোকা পালনকারীদের পুন্ড্ররিক বা পুন্ড্র বা পঁড়ো নামে অবহিত করা হতো। বর্তমানে তাদের বসনি বলা হয়। ভোলাহাটেও রেশম চাষীদের বসনি বলা হয়।
যুগে যুগে অবিভক্ত বাংলাসহ এ উপমহাদেশে রেশম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল, তা শত শত বছর পূর্বে হতেই পর্যটকদের ভ্রমণ কাহিনী ও ডাইরীর পাতা থেকে জানা যায়।
১৩৪০ খ্রিঃ ভারত বর্ষ পরিভ্রমন করে প্রখ্যাত মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন “ সুক্ষ্নতা ও কোমল পরিপাট্যের জন্য ভারত বর্ষের মসলিন রেশম বস্ত্র পৃথিবীর সর্বত্রই সমাদৃত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য চরিতমে পাওয়া যায়, নিজ লজ্জা শ্যাম পট্টশাটী পরিধাণ। অর্থাৎ তখন থেকেই শাড়ীর কদর ছিল। একই শতাব্দীর প্রথমার্ধে পর্যটক বার বোমা তার ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার রেশম বস্ত্রের সুখ্যাতির কথা উল্লেখ আছে। পর্যটক ষ্টেনশাম মাস্টার তার ডাইরীতে লিখেছেন “ কাশিম বাজার শহরের চর্তুরদিকে রেশম কীটের খাদ্য তুঁত গাছে পরিপূর্ণ ছিল।
মুসলিম আমলে গৌড়ের রাজ পরিবার ও রাজন্য বর্গের রাজ পোষাক ও সৌখিন বস্ত্র হিসেবে রেশমের প্রচুর চাহিদা দেখা দেয়ায় গৌড় নগরীর আশ পাশে ব্যপকভাবে রেশম চাষ শুরু হয়। এ সময় রেশমের ব্যপক চাহিদা ও উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনি রেশম চাষীরাও রেশম হতে প্রচুর আয় করতো। এর ফলে ঐতিহাসিক বাংলার রাজধানী গৌড় উপকণ্ঠে পিয়াসবাড়ী, ভোলাহাট, কালিয়াচক, সুজাপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে রেশম ও রেশম জাত বস্ত্র উৎপাদিত হত। যা এখনো এ সমস্ত স্থানে রেশম চাষ অব্যহত রয়েছে।
১৩৪০ খ্রিঃ ভারত বর্ষ পরিভ্রমন করে প্রখ্যাত মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছেন “ সুক্ষ্নতা ও কোমল পরিপাট্যের জন্য ভারত বর্ষের মসলিন রেশম বস্ত্র পৃথিবীর সর্বত্রই সমাদৃত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য চরিতমে পাওয়া যায়, নিজ লজ্জা শ্যাম পট্টশাটী পরিধাণ। অর্থাৎ তখন থেকেই শাড়ীর কদর ছিল। একই শতাব্দীর প্রথমার্ধে পর্যটক বার বোমা তার ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার রেশম বস্ত্রের সুখ্যাতির কথা উল্লেখ আছে। পর্যটক ষ্টেনশাম মাস্টার তার ডাইরীতে লিখেছেন “ কাশিম বাজার শহরের চর্তুরদিকে রেশম কীটের খাদ্য তুঁত গাছে পরিপূর্ণ ছিল।
মুসলিম আমলে গৌড়ের রাজ পরিবার ও রাজন্য বর্গের রাজ পোষাক ও সৌখিন বস্ত্র হিসেবে রেশমের প্রচুর চাহিদা দেখা দেয়ায় গৌড় নগরীর আশ পাশে ব্যপকভাবে রেশম চাষ শুরু হয়। এ সময় রেশমের ব্যপক চাহিদা ও উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনি রেশম চাষীরাও রেশম হতে প্রচুর আয় করতো। এর ফলে ঐতিহাসিক বাংলার রাজধানী গৌড় উপকণ্ঠে পিয়াসবাড়ী, ভোলাহাট, কালিয়াচক, সুজাপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে রেশম ও রেশম জাত বস্ত্র উৎপাদিত হত। যা এখনো এ সমস্ত স্থানে রেশম চাষ অব্যহত রয়েছে।
অনুরূপভাবে চাহিদা মিটাতেই প্রাচীনকালে পৌন্ড্রবর্ধনভূক্তির রাজধানী আধুনিক বগুড়ার মহাস্থানগড় এর চার পাশে যেমন বগুড়া, দিনাজপুর, ঘোড়াঘাট প্রভৃতি এলাকায় ব্যপক রেশম চাষ হতো। নবাবী আমলে মূর্শিদাবাদ রাজধানী থাকাকালে এর চার পাশে অর্থাৎ মূর্শিদাবাদ ছাড়াও রাজশাহী, জঙ্গিপুর, বেলগাঁও ও নদীয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যপক রেশম চাষ হতো বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। সুতরাং রেশম জাত বস্ত্র সৌখিনতা ও রাজ রাজন্য বর্গের যে “রাজ পোষাক” ছিল তা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। আর এ কারণেই সাধারণতঃ পুরাকালে রাজধানীর আশপাশেই সাধারণতঃ রেশম চাষ হতো তা বিভিন্ন বর্ণনা হতে প্রমাণ মিলে।
টমাস বাউরের “কান্ট্রিস-রাউন্ড-বে-অব বেংগল ১৬৬৯-৭৯ এর বাংলা অনুচ্ছেদে রেশম বস্ত্রের প্রাচুর্য্যের কথা উল্লেখিত আছে। একই শতাব্দির পরিব্রাজক বার্নিয়ার বাংলার রেশম ও কার্পাসের সম্ভার সম্পর্কে একই ভাষায় কথা বলেন।
আইন-ই-আকবরীতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট রেশম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত বলে জানা যায়। রিয়াজ-উস-সলাতীনে যশোরকে রেশম উৎপাদনকারী খ্যাত নামা স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।৮
বাংলার অনেক পরে মহিশূরে টিপু সুলতানের আমলে ভারতের বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে রেশম চাষ শুরু হয়। উল্লিখিত বর্ণনা হতে সহজেই সিদ্ধানে- উপনিত হওয়া যায় যে, বাংলায় কত পূর্ব হতে রেশম চাষ হয়ে আসছে। ঐতিহাসিক গৌড়ের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, পাল আমলের পর সেন আমলে আইহো, ভোলাহাট, মুচিয়া, নরহাট্টা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চল হতে পলু বা রেশম চাষ উঠে যায়।
বাংলার অনেক পরে মহিশূরে টিপু সুলতানের আমলে ভারতের বর্তমান কর্ণাটক রাজ্যে রেশম চাষ শুরু হয়। উল্লিখিত বর্ণনা হতে সহজেই সিদ্ধানে- উপনিত হওয়া যায় যে, বাংলায় কত পূর্ব হতে রেশম চাষ হয়ে আসছে। ঐতিহাসিক গৌড়ের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, পাল আমলের পর সেন আমলে আইহো, ভোলাহাট, মুচিয়া, নরহাট্টা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চল হতে পলু বা রেশম চাষ উঠে যায়।
গৌড়ের পাঠান ও সুলতানী রাজত্বকালে এবং মোঘল আমলে মূলতঃ সম্রাট শাজাহান-এর আমলে রেশম চাষের উন্নতি আরো চরম শিখরে উঠে। মধ্য যুগে বাংলার রেশম এতই বিখ্যাত ছিল যে, শের শাহের রাজত্বকালে বিখ্যাত দরবেশ শেখ বায়োজিদ শের শাহের সাথে কলকাপুরে স্বাক্ষাত করতে গেলে, শের শাহ তাকে বাংলার রেশমী পরিচ্ছদ দিয়ে সম্মানিত করেন। সে সময় এ দেশে যে সমস- রেশম গুটি পোকার ঐতিহ্যবাহী নাম ছিল, তার মধ্যে কয়েকটির নাম জানা যায়। এগুলোর মধ্যে বানেশ্বরী, আলতাপাটি, সোনামূখী প্রভৃতি। ঐ সময় এ দেশের রেশম চাষে, বয়ন, রঞ্জন ও কাপড়ের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। রেশম বস্ত্র স্বর্ণ ও রৌপ্য জড়ির দ্বারা নকশী ও নানা কারুকার্য্য খচিত চুমকীর কাজ করা কাপড় প্রধান সৌখিনতার সামগ্রী ছিল বলে জানা যায়। প্রাচীনকাল হতেই বৃহত্তর মালদহ ও মূর্শিদাবাদ-এ বিভিন্ন বর্ণের যেমন রেশম উৎপাদিত হতো, তেমনি ঐ সমস- এলাকার সুনিপূণরেশম কারীগরেরা বয়ন ও রঞ্জন বিদ্যায় পারদর্শী ছিল।
তৎকালীন সময়ে কি পরিমাণ রেশম সূতা ও বস্ত্র উৎপাদিত হতো যে, শেখ ভিখু নামক জনৈক মালদহের রেশম ব্যবসায়ী মালদহ হতে তিনটি বানিজ্য জাহাজে রেশম কাপড় ভর্তি করে ১৫৭৫ খ্রিঃ ইউরোপে (রাশিয়া) পাঠায়।
প্রখ্যাত ভূপর্যটক জন বার্নিয়ার একস্থানে বলেছেন যে, (১৬৩৩ খ্রিঃ) বাংলায় এত রেশম উৎপাদিত হতো যে, তিনি এ স্থানকে ইউরোপ মহাদেশের প্রসিদ্ধ বানিজ্য ভান্ডার বলে আখ্যায়িত করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে মোঘল শাসনামলে বেংগল সিল্ক নামে অবিভক্ত বাংলার এ শিল্প ছিল আর্থ সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি। বৃটিশ শাসনামলে তখন বাংলাকে রেশমের ভান্ডার বলে আখ্যায়িত করা হতো।
ঐতিহাসিক কাজী মিছের (বগুড়া) তার রাজশাহীর ইতিহাস গ্রন্থে ভোলাহাটকে “মহানন্দার তীরে অবসি'ত রেশমের প্রাচীন বন্দর হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলঃ
১৫৯৯ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখ টমাস স্মাইথের সভাপতিত্বে বৃটেনে ৮০ জন ফটকাবাজ ব্যবসায়ীর অংশীদারিত্ব নিয়ে গঠিত হয় প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।১৫ এদের প্রানি-ক পূঁজি ছিল মাত্র ত্রিশ হাজার পাউন্ড। ভারতে ইংরেজদের প্রথম কুঠি স্থাপিত হয় ভারতের পশ্চিম উপকুল বন্দর সুরাতে ১৬১৩ খ্রিঃ। ১৬৩৩ খ্রিঃ কোম্পানী বাংলার সাথে নামেমাত্র যোগাযোগ স্থাপন করে। প্রকৃত অর্থে ১৬৫০ খ্রিঃ কোম্পানী বাংলায় ব্যবসা প্রসারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সে উদ্দেশ্যে ১৬৫১ সালে হুগলিতে প্রথম কুঠি স্থাপন করে। প্রসিদ্ধ কুশামলমল প্রভৃতি সূতিবস্ত্রের জন্য মালদহে কুঠি স্থাপিত হয় ১৬৭৬ খ্রিঃ।১৬ প্রথমেই তাদের নজরে আসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী রেশম। কোম্পানী আমলে প্রথম দিকে বিপুল পরিমাণ রেশম বস্ত্র ও সূতা ইউরোপে রপ্তানী হতো। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর উপনিবেশীক শাসনে কিয়ৎকাল পরে উপমহাদেশের রেশম শিল্পের প্রতি নির্মম আঘাত হানা হয়। মূর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলার সুনিপূণ রেশম চাষী ও তন'বায়দের ওপর তারা অমানবিক নির্যাতন চালায়।
রেশম বয়নকারীদের সুনিপুনতার জন্য চক্রান- করে বৃদ্ধাংগুলি কেটে দেয়া হবে বলে হুমকী প্রদান করা হয়। এ এক নিষ্টুর কাহিনী, যা কল্প কাহিনীর মত আজো লোক মুখে শুনা যায়। এ সত্বেও ১৮৮৯ খ্রিঃ একটি রেশম ব্যবসায়ী কমিটি গঠণ ও ১৮৯৭ খ্রিঃ রাজশাহীতে একটি সেরিকালচার স্কুল চালু করা হয়।
তৎকালিন মালদহ জেলার ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, মুচিয়া, পিয়াজবাড়ী, সুজাপুর, কালিয়াচক এবং মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর ও বেলগাঁয়ে ব্যপক তুঁত ও রেশম চাষ হতো। শিবগঞ্জ, মহারাজপুর, হরিনগর, লাহারপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র বয়নের রেশম তাঁত কারখানা ছিল। বর্তমানেও উল্লিখিত স্থানগুলিতে অতীত ঐতিহ্য বিদ্যমান। তবে পরিমাণে অতি নগণ্য। এর মধ্যে বয়ন বিদ্যায় সুনাম হারিয়েছে শুধুমাত্র ভোলাহাট। কিন্তু কাঁচা রেশম উৎপাদন ভোলাহাটে আজো অব্যহত রয়েছে। অতীতে উল্লিখিত স্থান গুলিতে রেশম শাড়ী, চাদর, চেক থান প্রস'ত হতো। শাড়ীর নাম ছিল চন্দ্র হার, বানীচুর, চন্দ্রমূখী, কুমকুম, মালতি ও নিতাম্বরী। এ নিতাম্বরীকে অনেকে আগুন পাটের শাড়ী বলে উল্লেখ করতো। নিতাম্বরী শাড়ীর কথা আজো গ্রাম বাংলার ললনাদের মুখে মুখে গীত হিসেবে উচ্চারিত হয়।
এছাড়া রেইয়া ও মেঘলা নামেরও রেশম বস্ত্র প্রস'ত হতো। দেশী গাছ গাছড়া ও লাক্ষার রস দ্বারা বিভিন্ন রং তৈরী হত। সে সময় ভোলাহাটে রেশমের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে লাক্ষা (স্থানীয় ভাষায় লাহা বা গালা) উৎপাদিত হতো বলে জানা যায়। লাক্ষা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভোলাহাট হারিয়েছে তার অতীত ঐতিহ্য।
রেশম শিল্পের সুদিনে তুঁত চাষ ও তূঁত গাছ অত্যন- লাভজনক ফসলে পরিণত হয় এবং সেই সমস- জমিতে জমিদারেরা অস্বাভাবিক উঁচু হারে কর ধার্য্য করে। ঐতিহাসিক কাজী মিছের বলেছেন, রাজশাহী জেলার পশ্চিম সীমানে- মহানন্দ নদীর তীরে ভোলাহাট রেশম শিল্পের কারখানার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল হতে বিখ্যাত। এখানে হাজার হাজার লোক কোম্পানীর রেশম কারখানায় শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখনো তুঁত চাষের জন্য ভোলাহাট বিখ্যাত। বৃটিশদের অত্যাচারের ফলে যেমন দেশীয় রেশম বয়ন শিল্প মারাত্মক হুমকীর সম্মূখিন হয়, তেমনই তৎকালিন সরকারের অবহেলা, ঔদাসিন্য, রেশমের বিপরীতে বিকল্প অধিক লাভজনক ব্যবসা নীল চাষ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পট পরিবর্তন এবং পেব্রিণ নামক এক-কোষী প্রাণীর আক্রামনে রেশম চাষ ব্যপক ক্ষতি হয়। ফলে “বনের পাতা খেয়ে পোকা, ঢেলে দেয় সোনার টাকা” বলে যুগ যুগ ধরে রেশম চাষীদের মাঝে রেশমের যে গাঁথা প্রচলিত ছিল তা স্তব্ধ হয়ে যায়।
পেব্রিণের প্রার্দূভাব হতে রেশম শিল্পকে রক্ষা করার কোন চেষ্টাই সে সময়ে বৃটিশ সরকার গ্রহণ করেনি। ফলে রেশম শিল্পের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। এমনকি রেশম চাষ কোন কোন এলাকা হতে একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ভোলাহাট উপজেলার ৪নং জামবাড়ীয়া ইউনিয়ন মুশরীভূজা পোল্লাডাঙ্গা, সুরানপুরসহ নানা স্থান হতে রেশম চাষ বিলুপ্তি ঘটে। অথচ বহু পূর্ব হতে এ উপজেলার জামবাড়ীয়া ইউনিয়নের নানা স্থানে রেশম চাষ হতো। জামবাড়ীয়ার আদমপুর গ্রামে ইংরেজদের রেশম কুঠিবাড়ী ছিল বলে জানা যায়। ১৮৫৯-৬০ খ্রিঃ সমগ্র বাংলাব্যাপী যে নীল বিদ্রোহ শুরু হয় তার রোশানলে পড়ে তৎকালীন মালদহ জেলার এ থানার ২টি রেশম কুঠি বাড়ী আক্রান- হয়। প্রজা সাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে নীল কুঠি ও বেশ ক’টি রেশম কুঠি আক্রমন করে কয়েক জন ইংরেজ দেওয়ান ও বহু কর্মচারীকে হত্যা করে। এর মধ্যে তৎকালীন ভোলাহাট থানার জামবাড়ীয়া ইউনিয়নের আদমপুর রেশম কুঠি ও ভোলাহাট রেশম কুঠি আক্রান্ত হয়।
এতে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, ভোলাহাট এলাকায় অতীতে কখনো নীল চাষ হয় নি বা হতো না। তবে হালে ২০০০ সালে ভোলাহাট রেশম বীজাগার চত্বরে তৎকালীন ফার্ম ম্যানেজার ভোলাহাট উপজেলার পাঁচটিকরী গ্রামের মোঃ মনিরুল ইসলাম রাজশাহী চারঘাট থানার মিরগঞ্জ এলাকা হতে কিছু নীল গাছ বীজাগার অভ্যান-রে রক্ষিত মেসার্স লুই পেইন কোম্পানীর রেশম কুঠির (রেশম ড্রাই কাজে ব্যবহৃত) পরিত্যক্ত বয়লারের সামনে লাগিয়েছেন। এতে ভবিষ্যতে এ এলাকায় বিতর্কের ঝড় তুলতে পারে যে, অতীতে কখনো এ এলাকায় নীল চাষ করা হতো। যাই হোক, বৃটিশ আমলে কাঁচা রেশম উৎপাদনের জন্য মেসার্স ওয়াটশন কোম্পানী উত্তর বঙ্গেঁ ১৮৩৫ খ্রিঃ ১৫২টি কুঠিবাড়ী এবং রেশমের পাশা পাশি নীলের কারখানা চালু করে। অবশ্য ১৬৭৬ খ্রিঃ থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ব্যবসা সংক্রান- কাজে এসে রেশম কুঠি নির্মাণ করে বলে জানা যায়। আবার ১৮৬৮ খ্রিঃ এলাকায় ইংরেজরা ৭২টি কুঠি স্থাপন করে বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
রাজশাহীতে মেসার্স এ্যান্ডারসন (শিরইল) বেঙ্গঁল সিল্ক কোম্পানী, মেসার্স লুইপেইন এন্ড কোম্পানী কাজলা ও ভোলাহাট-এ রেশম কারখানা স্থাপন করে। সেই সময় রেশম পোকার মড়কের যুগেও যে কি পরিমাণ রেশম উৎপাদিত হতো তা ভাষায় বর্ণনাতীত। ১৮৭১ সালের রাজশাহী কালেক্টরের এক রিপোর্টে দেখা যায়, মেসার্স ওয়াটশন কোম্পানীর কারখানাগুলিতে আট হাজার থেকে নয় হাজার শ্রমিক নিয়োজিত ছিল এবং বার্ষিক রেশম সূতা ওরেশম সামগ্রীর উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দুই হাজার মন। রেশম শিল্পের এহেন প্রতিকুলতার মধ্যেও ১৮৮১-৮২ সালে বাংলাদেশ হতে ৩,৭৮,৯৪০ টাকা মূল্যের ৯৩,১৪৬ মন রেশম বিদেশে রপ্তানী হয়েছে। -উপজেলা প্রশাসন ভোলাহাট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন