শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আসুন আমাদের প্রয়োজনেই আমরা আমাদের জীববৈচিত্রকে রক্ষা করি

 প্রতি বছর ২২ শে মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালন করা হয়। জীববৈচিত্র্য হচ্ছে সব ধরনের উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণিসত্তার মধ্যে ভিন্নতা। ব্যাপক অর্থে পৃথিবীতে জীবনের উপস্খিতি অর্থাৎ ‘লাইফ অন আর্থই জীববৈচিত্র্য। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্খান, স্বাস্খ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে আমরা পুরোপুরিভাবে জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের সাথে আমাদের জনগণের জীবন ও জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীববৈচিত্র্য অন্ন, চিকিৎসাসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবা করার পাশাপাশি আবহাওয়া স্খিতিশীল রাখে ও মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্খা, বসত বিনাশ ও খণ্ডায়ন, পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল ধ্বংস, অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ ও বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। 

কোনো বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশে যদি কোনো বড় ও দীর্ঘস্খায়ী পরিবর্তন দেখা যায়, তবে ওই বাস্তুতন্ত্রের জীবসম্পদের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফলে বহু ক্ষেত্রে সেই বাস্তুতন্ত্রের জীবসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি হয়। এর দরুন খাদ্যচক্রে শক্তি প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটে এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে মানবজাতির অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ে। রেশম চাষ, মৌমাছি চাষ, মৎস্য চাষ,বন সম্পদ ইত্যাদি জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল যা অর্থনীতির সাথে জড়িত। পৃথিবীর দরিদ্র জনগণের ৯০ শতাংশ তাদের জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। একশ’ কোটিরও বেশি মানুষ বিশ্বের ১৯টি জীববৈচিত্র্য ভরপুর এলাকায় বাস করে। উদ্ভিদ সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই এক্সাইড গ্রহণ করে আবহাওয়ামণ্ডলের কার্বন-ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো গাছের শুষ্ক ওজনের ৫০ শতাংশই কার্বন। গাছপালার আচ্ছাদন ভূমিক্ষয় রোধ করে মাটির কণায় আবদ্ধ জৈবিক কার্বনকে আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে বিশ্বে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। বায়ু, পানি ও মাটিতে প্রতি বছর ৩০০ কোটি টনের বেশি ক্ষতিকর পদার্থ মিশে যাচ্ছে। পৃথিবীর বায়ুস্তরের ২০ কোটি টন কার্বন-ডাই অক্সাইড জমছে। কল-কারখানার ধোঁয়ার সাথে বাতাসে মিশছে ১৬ কোটি টন নাইট্রিক অ্যাসিড। এতে অনরবত তাপমাত্রা বাড়ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জীববৈচিত্র্যতার সমস্যা দেখা দেয়। জীববৈচিত্র্য ভেঙে যাওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০ শতাংশ পেঁচা মারা যাওয়া, পোল্যান্ডের ৪৩ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৮০টি বিপন্ন প্রজাতির জীব সমুদ্রতলে হারিয়ে যাবে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। ১০ কোটি হেক্টর ভূখণ্ডের উর্বর মাটির স্তর বিভিন্ন কারণে ক্ষয় হচ্ছে। ভূমিক্ষয়ের ফলে প্রতি বছর ৬০ লাখ থেকে ৭০ লাখ হেক্টর জমি চাষের অযোগ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি দাঁড়াবে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাতীয় আয়ের ৩০ শতাংশ জীববৈচিত্র্য থেকে আসে। প্রতি বছর ২৫ হাজার স্তন্যপায়ী, ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ পাখি, ১ কোটি সরীসৃপের চামড়া এবং ২৫ কোটিরও বেশি ক্রান্তীয় মৎস্য ব্যবসায়ের তাগিদে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে। ১৪টি পশু-পাখি আমাদের প্রাণিজ আমিষের যোগানদার। আতঙ্কিত হতে হয় ৬ হাজার ৩০০ গবাদিপশু জাতের মধ্যে ১ হাজার ৩৫০ প্রজাতি বহুবিধ কারণে ইতোমধ্যেই নি:শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাপানিরা মনে করে, আটলান্টিক মহাসাগরে প্রায় ৭৬০ হাজার এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় ২৫ হাজার তিমি রয়েছে। তারা তিমি শিকারের অধিকার চায়। সাইট্রেস সম্মেলনে এ দাবির সাথে তাল মিলিয়ে নরওয়ে বলছে, প্রতি বছর ২০০০ করে তিমি ধরলে আগামী ১০০ বছর পর্যন্ত এ প্রজাতির অবস্খা বিপন্ন হবে না। বাঘের হাড়গোড় একজন চীনা ১০ হাজার ডলার দিয়ে কিনতে রাজি। উন্নত দেশে ফার্মের মালিকরা ফল ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মৌমাছির মালিকদের কাছ থেকে মৌমাছি ভাড়া করে আনে। 
বর্তমানে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের ৯৫ শতাংশ মাত্র ৩০টি প্রজাতির উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এক সময় প্রায় ১৮ হাজার প্রজাতির ধান উৎপন্ন হলেও বর্তমানে তা কমে ঠেকেছে প্রায় ১৫-৩০ প্রজাতিতে। মাত্র ৪টি মাঠ ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, আলু মোট খাবারের অর্ধেক সরবরাহ করে। পৃথিবীর স্খলভাগের ৪০ শতাংশ জমি কৃষিকাজে ব্যবহার হয়। 
পৃথিবীজুড়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি কারো একার দায়িত্ব নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে বিলুপ্তির সাথে মানুষের আগ্রাসন যুক্ত হলে জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় জীববৈচিত্র্য দীর্ঘ দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। 
যদিও বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ তবুও এখানে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সমস্যাও প্রকট। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ সংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশ তা অনুমোদন করছে। আমরা নষ্ট পরিবেশকে আবার সুস্খ করতে জীববৈচিত্র্যকে ধরে রাখতে চাই। এক কথায় জীববৈচিত্র্যের বিকল্প কিছুই নেই। সুষ্ঠুভাবে যারা পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের সব ধরনের সামাজিক, অর্থনেতিক ও পরিবেশীয় অবস্খা মেটাতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন আমরা সবাই আমাদের জীব বৈচিত্র রক্ষায় সচেষ্ট হই। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন